মনে হচ্ছে বরফ গলতে শুরু করেছে। অনেক দেরিতে হলেও। দেরিটা বলতে গেলে একেবারে কাটায় কাটায় সাড়ে চার দশকের চেয়ে সপ্তাহ পাঁচেক বেশি। একদা এই দেশে একজন মানুষ ছিলেন যিনি দেশের মানুষের আর্থসামাজিক ও রাজনীতিক মুক্তির লক্ষ্যে একটি আর্থনীতিক নীতি প্রণয়ন করেছিলেন। এই নীতিটি কার্যকর করার লক্ষ্যে তিনি দেশটিকে ‘একদল এক নীতির দেশ’ করে তোলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেন নি। দেশের ভেতরে জনগণের শত্রুরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাঁকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেছিল।
হ্যাঁ, এখানে বঙ্গবন্ধুর কথাই বলা হচ্ছে, আর বলা হচ্ছে তাঁর বিখ্যাত বাকশালনীতির কথা। তিনি প্রথম স্বাধীনতা দিবসের (১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ) বেতার-টিভির ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমার সরকার অভ্যন্তরীণ সমাজবিপ্লবে বিশ্বাস করে। এটা কোনো অগণতান্ত্রিক কথা নয়। আমার সরকার ও পার্টি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। একটি নতুন ব্যবস্থার ভিত রচনার জন্য পুরাতন সমাজব্যবস্থা উপড়ে ফেলতে হবে। আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়বো।’
এরপর কাউকে বুঝিয়ে বলার দরকার নেই যে, বঙ্গবন্ধু সেদিন কী বলতে চেয়েছিলেন। তিনি যে মিথ্যাচার করেন নি, তাঁর প্রতিশ্রুতি যে তিনি রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, তার প্রমাণ শত্রুরা তাঁকে হত্যা করেছিল বাকশালব্যবস্থা দেশে কার্যকর করার প্রাক্কালে এবং তারা এও প্রমাণ করেছিল যে তারা মুজিবের মতো শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থার পক্ষে নয়, তারা গণতন্ত্রের নামে কার্যত স্বৈরতন্ত্র চালু করেছিল।
খুনিরা বহুদলীয় গণতন্ত্রের কথা বলে দেশের মানুষকে সেদিন ভুল বুঝিয়েছিল এবং কার্যত বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে তারা হত্যা করেছিল জনগণের গণতন্ত্রকে, তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের আড়ালে স্বৈরতন্ত্রকে পুরিপুষ্ট করে জনশোষণমূলক পুঁজিবাদী আর্থব্যবস্থা বহাল রেখেছিল এবং যথারীতি জননির্যাতনের তীব্রতাকেই বৃদ্ধি করেছিল এবং অর্থনীতিতে পাকাপুক্ত করেছিল দুর্নীতিকে ও লুটপাটকে, যা এখনও অব্যাহত আছে, বঙ্গবন্ধুতনয়া যে-দুর্নীতি ও লুটপাটের প্রতি শূন্যসহনশীলতার নীতি কার্যকর করেও থামাতে গিয়ে প্রতিনিয়ত গলদঘর্ম হচ্ছেন।
তবে আশার কথা এই যে, গত শুক্রবার (১৮ সেপ্টেম্বর) মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘বাকশালের অর্থনীতি ছাড়া জাতির মুক্তি হবে না।’ এই সত্য উপলব্ধির জন্য, জাতির মুক্তির কথা ভাবার জন্য এবং জনসমক্ষে বলার জন্য তাঁকে অশেষ ধন্যবাদ। দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের একজনের উপলব্ধিতে বঙ্গবন্ধুর শোষণমুক্তির ভাবনাটি জায়গা পেয়েছে। অথচ ইতোমধ্যে অনেকে মন্ত্রী হয়েছেন, কোনও মন্ত্রীই এইভাবে প্রকাশ্যে জনগণের শোষণমুক্তি কথা বলতে গিয়ে বাকশাল অর্থনীতির কথা বলেন নি, বরং তাঁরা বাকশালনীতির কথা ইচ্ছে করে ভুলে ছিলেন বলেই মনে হয়। তার কারণ বোধ করি তাঁরা সকলেই জানতেন যে, বাকশাল অর্থনীতি ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মধ্যে কোনও তফাৎ নেই। পরিশেষে বলি, যার ভেতরে যে-ভাবনাই থাকুক না কেন, দেশের মানুষের ভাবনা কিন্তু একটাই, তাঁরা বঙ্গবন্ধুর মতোই চান দেশে ‘অভ্যন্তরীণ সমাজবিপ্লব’ হোক, তাঁরা যে-করেই হোক শোষণ থেকে মুক্তি চান।