:: সুখেন্দু সেন ::
ইলিশ, পেঁয়াজ, খিচুড়ি ক’দিন ধরেই ভিন্ন মাত্রার ঘ্রাণ, ঝাঁজ আর স্বাদ ছড়াচ্ছে। এক সময়ের রূপোলি ইলিশের সোনালী দিনে, প্রাচুর্য ও সহজলভ্যতায় স্বাধীনদেশে জাতীয় মাছের মর্যাদা পেয়েছিল গভীর জলের রূপসী প্রাণীটি। মওসুমে বরফবন্দী নরম সরম ইলিশের অভাব হতো না হাটে বাজারে। বলতে গেলে ধনী গরিবের সমান অধিকারই ছিল। অবশ্য এর স্বাদ-গন্ধের বিষয়টিও অস্বীকার করার নয়। বিশেষ করে পদ্মার ইলিশের। তা সত্বেও উৎসবে ব্যসনে ইলিশ আপ্যায়ন একদা নিন্দনীয় ছিল বঙ্গদেশে।
মহার্ঘ্য ইলিশের এখন জৌলুস বেড়েছে। কৌলিন্যে ছাড়িয়ে গেছে সাবেকী বনেদী মাছেদেরও। মৎস্যকুলে কেবল পদ্মার ইলিশের রয়েছে কূটনীতিক মর্যাদা। ক্ষীণপ্রাণা ইলিশের মোহনীয় ক্ষমতাও বেশ। ওপার বাংলার ভোজন রসিক বাঙালি বাবুদের কাবু করতে ইলিশ অনেক সময়ই ভূমিকা রাখে।
জাতীয় মাছ হলে কি হবে, দুর্মূল্যের কারণে ইলিশ অধিকাংশেরই নাগালের বাইরে। বৎসরে দু-একবার পাতে ওঠে কিনা সন্দেহ। একেবারে না ওঠলেও আমজনতার মরমে ইলিশব্যথা তেমন কুকড়ে উঠে না। পদ্মার ইলিশ রফতানি খবর হয় ঠিকই কিন্তু গরিবের ভাগ্যে চাটগাঁ, বরিশালের ইলিশও এখন আর তেমন জুটে না।
মশলা জগতে পেঁয়াজের মত ক্ষমতাধর এবং দারুণ ক্রিয়াশীল আর কোনো উপাদান নেই। গরম মশলাও এতোখানি গরম দেখাতে পারেনি কোনো কালে। জাতির মাথা গরম আর সরকারের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে যায় পেঁয়াজ সংকট। তীব্র ঝাঁজের সঙ্গে বিপুল ক্ষমতার যুগল বন্দী পেয়াঁজকে দিয়েছে অতুলনীয় মহিমা। ভিন দেশ পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের ঘোষণা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গুদামে মজুদ পেয়াঁজ স্বমহিমায় দুর্মূল্য হতে থাকে। আপন গরিমায় ফুলে ফেপে চলে যায় সাধারণ ক্রেতার ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। পেঁয়াজ মোহে মানুষও ছুটে উদভ্রান্তের মতো। এক কেজির স্থলে তিন কেজি কিনে ধন্য হয়। যেনো ছলনাময়ী সোনার হরিণীকে এখনই থলে বন্দী করা চাই। কিন্তু পেঁয়াজের দুর্ভাগ্য, এত জনপ্রিয়তার পরও জাতীয় মশলার মর্যাদা পেলোনা।
খিচুড়ি। উৎপত্তিগতভাবে কোন ঘরানার খাবার তা বিশ্লেষণে না গিয়েও বলা যায় এদেশের গ্রাম, শহর, ধনী, দরিদ্র, ধর্ম, বর্ণ, জাত পাত, সম্প্রদায় নির্বিশেষে খিচুড়ি একটি অতি সাধারণ খাদ্য। ডালে-চালে সহজ রন্ধন প্রণালী, সহজ পাচ্যতার কারণে এর জনপ্রিয়তা দারুণ, উপকারিতাও বেশ।
দুর্যোগে, দুর্বিপাকে, দুর্ভিক্ষে, ধর্মীয় উৎসবে, আপ্যায়নে, করোনা কালে, বানে, ত্রাণে এটি বহুল প্রচলিত খাদ্য। সংকটে জীবন রক্ষায় এর যেমন অবদান, ভোজন রসিকদের বিলাসী রসনাতেও এর যোগান বহুমাত্রিক। বৃষ্টির দিনে নানা উপকরণে প্রস্তুত খিচুড়ির মনকাড়া স্বাদ ও ঘ্রাণ উপভোগের অভিজ্ঞতা বাঙালি মাত্রেই রয়েছে। আর এবারের করোনা কালে ঘরে বাইরে খিচুড়ির অবদান অনস্বীকার্য। কত ধরনের খিচুড়ি রেসিপিসহ ভাইরাল হয়ে রন্ধনশিল্পকে সমৃদ্ধ করেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না আর কত সংগঠনের বিচিত্র কায়দা ও ভঙ্গিমায় খিচুড়ি বিতরণ ত্রাণ তৎপরতার ক্ষেত্রেও বিপ্লব এনেছে। বাঙালির অনুসন্ধিৎসু মন এতেই ক্ষান্ত হলো না। দেশীয় খিচুড়িতে আন্তর্জাতিক প্রণালী প্রযুক্তকরণ এবং স্বাদ সংযুক্তির অভাবনীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন সংশ্লিষ্ট দফতরের রসিক আমলারা। আর জাতিকে বঞ্চিত করে সে ঐতিহাসিকপরিকল্পনা নাকি ভেস্তে দিয়েছেন আমাদের বেরসিক মন্ত্রী মহোদয়।