শহীদনূর আহমেদ ::
চলতি বছরের জুন, জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর এই ৪ মাসে সুনামগঞ্জ-নেত্রকোনা হাওরে নৌ দুর্ঘটনায় ৩৬ জনের মর্মান্তিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে দিরাইয়ের কালিয়াকোটা হাওরে নৌকাডুবিতে নিহত হন ১০ জন। এক বছরে হাওরে ডুবে প্রাণ গেছে প্রায় অর্ধশত মানুষের। প্রতিকূল আবহাওয়া, অধিক যাত্রী বোঝাই, নৌ ব্যবস্থাপনা না মানায় এমন দুর্ঘটনা ঘটছে বলে মনে করছেন হাওরপাড়ের বাসিন্দারা। হাওরে নৌকাডুবির ঘটনায় নৌযান চলাচলে কঠোর নির্দেশ প্রদান করেছে প্রশাসন। হাওরে নৌকাডুবি এড়াতে ইতোমধ্যে ১৪ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
জানাযায়, চলতি বছরের ২৭ জুন দিরাই উপজেলার কালনী নদীতে নৌকা ডুবিতে শিশুসহ ২ জন নিহত হন। জুলাই-আগস্ট মাসে জেলার ধর্মপাশা, তাহিরপুর ও ছাতক উপজেলায় নৌকা ডুবির ঘটনায় ৫ জনের প্রাণহানি ঘটে। এদের মধ্যে ৩ জন তাহিরপুর উপজেলার। ৫ আগস্ট নেত্রকোনার মদন উপজেলার হাওরে নৌকা ডুবে ১৭ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। চলতি মাসের ৯ তারিখ সুনামগঞ্জ-নেত্রকোনার মধ্যবর্তী গুমাই নদীতে নৌকা ডুবির ঘটনায় নারী শিশুসহ ১২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর দিরাই উপজেলার বিয়ে বাড়িতে যোগ দিতে গিয়ে কালিয়াকোটা হাওরে নৌকা ডুবে ৬ শিশুসহ ১০ জন মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এছাড়াও জেলার বিভিন্ন হাওরে বিচ্ছিন্নভাবে নৌ দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে যা সংবাদের বাইরে থাকছে বলে জানাযায়।
হাওরের বাসিন্দারা জানান, নৌযান চলাচলে কোন নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না। এ কারণে ট্রলার বা নৌকাচালকরা নিজের ইচ্ছামত অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে চলাচল করে থাকেন। ফলে প্রতিনিয়তই ঘটছে নৌ দুর্ঘটনা। নৌপথে এরকম দুর্ঘটনারোধ করতে ট্রলার বা নৌকার ফিটনেস যাচাই, যাত্রী ধারণ ক্ষমতা, যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য লাইফ জ্যাকেট নিশ্চিত করা প্রয়োজন। স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক নৌঘাট থেকে রাজস্ব আদায়ের পাশাপাশি যাত্রী সুরক্ষার জন্য নিয়মনীতি প্রণয়ন করাও জরুরি। তা না হলে নৌপথে প্রাণহানির ঘটনা রোধ করা সম্ভব নয়।
হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, হাওরের জনপদ সুনামগঞ্জ ৬ মাসই পানি নিচে থাকে। বর্ষায় বেশিরভাগ উপজেলার মানুষের যাতায়াতের প্রধান বাহন নৌকা। হাওরের বৈরী আবহাওয়া ও নৌযান চলাচলে নির্দিষ্ট নিয়ম না মানায় ঘটছে দুর্ঘটনা। চালক ও যাত্রীরা সচেতন হলেই নৌদুর্ঘটনা অনেকটা রোধ করা সম্ভব। সড়ক পথের মত নৌপথে নিয়ম-নীতির দরকার। যেসকল নৌকা চালক এসব মানবেন না তাদেরকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
এদিকে নৌপথে অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা এড়ানোর লক্ষ্যে প্রচলিত আইন ও বিধি বিধানসহ ১৪টি নির্দেশনা প্রদান করেছে জেলা প্রশাসন। এতে বলা হয়েছে- অভ্যন্তরীণ নৌযানসমূহকে সার্ভে এবং নিবন্ধন করতে হবে, সার্ভে সার্টিফিকেট (ফিটনেস) নৌযানের প্রকাশ্য স্থানে ঝুলিয়ে রাখতে হবে, নিবন্ধন সনদপত্র নৌযানে রাখতে হবে, রেজিস্ট্রেশন নম্বর প্রকাশ্য স্থানে উৎকীর্ণ থাকবে, প্রতিটি নৌযানে আসন সংখ্যা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সংখ্যক লাইফ জ্যাকেট/ভয়া যাত্রী সাধারণের হাতের নাগালের মধ্যে রাখতে হবে, আসন সংখ্যার চেয়ে অধিক যাত্রী বহন করা যাবে না, দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালক এবং সহকারী দ্বারা নৌযান চালানো নিশ্চিত করতে হবে; সাইরেন ও সার্চ লাইট/সিগন্যাল লাইট ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে, মালবাহী নৌযানে নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত মালামাল পরিবহন করা যাবেনা, নৌযান চালকের দক্ষতা, প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতার সনদ গ্রহণ করতে এবং তা নৌযান চালনাকালে সংরক্ষণ করতে হবে। এছাড়া আবহাওয়া পূর্বাভাস মেনে নৌযান চালাতে হবে, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় নৌযান চালানো থেকে বিরত থাকতে হবে, সকল প্রকার সংঘর্ষ ও দুর্ঘটনা এড়িয়ে নৌযান চালাতে হবে, কোনভাবেই ধারণ ক্ষমতার অধিক যাত্রী/মালামাল বা পণ্য পরিবহন করা যাবেনা মর্মে নির্দেশনা প্রদান করা হয়।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ জানান, নৌ দুর্ঘটনা রোধে আমরা ইতোমধ্যেই ১৪টি নির্দেশনা দিয়েছি। ট্রলারঘাটসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এসব নির্দেশনা টাঙিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যারা নির্দেশনা অমান্য করবে তাদের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল অধ্যাদেশ, ১৯৭৬ ও বাংলাদেশ বাণিজ্যিক নৌ-চলাচল অধ্যাদেশ, ১৯৮৩ এবং প্রচলিত আইন ও বিধি মোতাবেক মোবাইল কোর্ট পরিচালনাসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।