শামস শামীম ও সাজ্জাদ হোসাইন শাহ ::
তাহিরপুর সীমান্তে পাহাড়ি ঢলের আগ্রাসন বেড়েই চলছে। ঢলের তোড়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে সড়ক। বালু-পাথরে চাপা পড়েছে ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, হাওর, খাল-বিল। এবারের তিন দফা বন্যা, পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণও বেড়েছে। ঢলে নেমে আসা বালু-পাথরে বসতঘর চাপা পড়ে কয়েকটি আদিবাসী পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়ে মেঘালয় পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
তাহিরপুর সীমান্তে বসবাসকারী লোকজন জানান, মেঘালয়ের খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থানের ফলে বর্ষা মওসুমে পাহাড়ি ঢলের আগ্রাসনের শিকার হন তারা। মেঘালয়ে ভারত সরকার দীর্ঘদিন ধরে কয়লা খনি খননের পর থেকেই মূলত পাহাড় ধসের ঘটনা বৃদ্ধি পায়। তাই প্রতি বছরই বর্ষায় বালু-পাথর নেমে আসছে।
সরেজমিন সীমান্তে গিয়ে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানাযায়, ২০০৮ সালের ১৩-২১ আগস্ট টানা বর্ষণে ভারতের ওয়েস্টহিল খাসিয়া পাহাড় (কালা পাহাড়) ভেঙে তাহিরপুরের সীমান্তবর্তী চানপুর-রজনীলাইন-পাহাড়তলি, কড়ইগড়া, লালঘাট, ভুরুঙ্গাছড়ায় প্রায় ৪০০ একর কৃষিজমি ভরাট হয়। প্রায় ২০০ পরিবার কৃষিজমি ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়। এলাকায় ফসলি জমি, ঘরবাড়ি, পুকুর, হাওর বালু ও পাথরে চাপা পড়ে। ভরাট হয়ে যায় পাহাড়ি ছড়া ও একাধিক পুকুর। এ সময় পাহাড় থেকে নেমে আসা বালু-পাথরে চাপা পড়ে কয়েকজন আহতও হন। চানপুর গ্রামের মেজর মৃ, সফলা সাংমা, উদাস সাংমা ও তার দুই মেয়েসহ আরও কয়েকজন আদিবাসী বাস্তুভিটা হারিয়ে তখন চানপুর পাহাড়ে আশ্রয় নেন।
২০০৮ সালে পাহাড় ধসের ঘটনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কৃষি উপদেষ্টা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দিন সুনামগঞ্জ শহরের শহীদ আবুল হোসেন মিলনায়তনে নাগরিক সমাবেশ করলে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে খাসিয়া রাজার ছেলে আদিবাসী নেতা এন্ড্রু সলোমারের নেতৃত্বে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। এদিকে ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে আবারও পাহাড়ি ঢলে ওই এলাকায় প্রায় ২শ একর ফসলি জমি বালুতে ভরাট হয়ে যায়। এসময় কড়ইগড়া ছড়ায় স্লুসইসগেইটের তীরের বাঁধ ভেঙে ১০টি আদিবাসী পরিবারের বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাজাই গ্রামের এন্ড্রু সলোমার, সম্রাট মিয়া, ইউসুফ মল্লিক, আব্দুল আলী, জুয়েল মিয়া, আকবর আলী, মেজর উদাস সাংমা, সফলা মারাকের প্রায় দুইশ একর আমন জমি বালুতে ভরাট হয়ে যায়। কড়ইগড়া স্লুইসগেটের বাঁধ ভেঙে রমেশ মারাক, রোটালি দিও, লুসেন রাকসাম, রোটন ম্রং, মাইকেল ডিও ও সঞ্চিতা রাকসামের বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অন্যদিকে সম্প্রতি গত জুন ও জুলাই মাসের তিন দফা বন্যায় আবারও ওই এলাকায় বালু-পাথর নেমে এসে ফসলি জমি, রাস্তাঘাট, পুকুর, ঘরবাড়ি চাপা পড়ে। পচাশোল হাওর বালু পাথরের বেশ কিছু জমিও নতুন করে বালুতে ভরাট হয়ে যায়। বড়গোপ-টেকেরঘাট সড়কের তিনটি সেতুর নিচে বালু-পাথরের স্তূপ তৈরি হয়েছে। চানপুর সড়কের প্রায় ২০০ কি.মি. এলাকা পাহাড়ি ঢলের তোড়ে বিলীন হয়ে গেছে। বড়গোপটিলার নিচে অবস্থিত কমিউনিটি ক্লিনিক ও ফসলি জমি বালুতে চাপা পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। এবারের ঢলের সঙ্গে নেমে আসা বালু-পাথরে রাজাই গ্রামের খাসিয়া রাজা উইক্লিব সিমের ছেলে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কোষাধ্যক্ষ এন্ড্রু সলোমারের প্রায় ২০ একর জমি বালু ও পাথরে চাপা পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। বড়গোপটিলার নিচে তাহিরপুর ট্রাইব্যাল ফোরামের সাবেক সভাপতি পরিতোষ চাম্বুগং-এর এক একর ফসলি জমি বালুতে ভরাট হয়ে গেছে।
উত্তর বড়দল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও আদিবাসী নেতা শঙ্কর মারাক বলেন, প্রতি বছরই মেঘালয় পাহাড় থেকে ঢলের সঙ্গে নেমে আসা বালু-পাথরে আমাদের এরাকার প্রকৃতি পরিবেশ ও কৃষি জমি নষ্ট হচ্ছে। এবার কড়ইগড়া কমিউনিটি ক্লিনিক, ক্লিনিকের পাশের ফসলি জমি বালুতে ভরাট হয়ে গেছে। সীমান্তে বসবাসকারী কয়েকটি আদিবাসী পরিবার এ কারণে বাস্তুচ্যুত হয়ে অন্যত্র চলে গেছে।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কোষাধ্যক্ষ ও আদিবাসী নেতা এন্ড্রু সলোমার বলেন, ভারতের মেঘালয়ে অপরিকল্পিত কয়লা ও ইউরেনিয়াম খনি খননের পর থেকেই মূলত পাহাড় ভেঙে আমাদের ভাটির জনপদ তাহিরপুর সীমান্তে বিপর্যয় নেমে এসেছে। আমার প্রায় ২০ একর জমি নষ্ট হয়ে গেছে বালুতে। এভাবে প্রতি বছরই ক্ষতি হচ্ছে। তিনি বলেন, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে এ বিষয়ে সংলাপ করে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. সফর উদ্দিন বলেন, তাহিরপুর সীমান্তে সম্প্রতি হাওর ও আমন জমি বালু ও পাথরে চাপা পড়ার খবর আমরা পাচ্ছি। এতে আমাদের প্রচুর কৃষি জমি নষ্ট হচ্ছে। কি পরিমাণ জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমরা সে বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছি।