:: লতিফুর রহমান রাজু ::
রেজাউর রহমান রেজা, সুনামগঞ্জের অতিপরিচিত মুখ। সুনামগঞ্জ থেকে প্রকাশিত প্রথম নিয়মিত ‘সাপ্তাহিক সুনামগঞ্জ’-এর সম্পাদক ও প্রকাশক। পাশাপাশি তখনকার বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিক ‘সংবাদ’-এর সুনামগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘ দিন। শহরের হাছননগরের বাসিন্দা। বাচ্চাদের আরও ভাল স্কুলে পড়াশোনা করাতে পরিবার নিয়ে বেশ কিছুদিন যাবত সিলেট বসবাস করছিলেন। অতি সম্প্রতি রেজা ভাই না ফেরার দেশে চলে গেলেন।
বৈশ্বিক মহামারী করোনা ও বন্যা পরিস্থিতির মধ্যেই রেজা ভাই সিলেটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। শুনেছি বেশ কিছুদিন ধরে তাঁর শারীরিক অবস্থা খুব একটা ভালো যাচ্ছিল না। অনেক দিন হয় রেজা ভাইয়ের সাথে আমার যোগাযোগ ও দেখা ছিল না। সুনামগঞ্জের আরেক পরিচিত মুখ কবি, সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদ সাবরী সাবেরীন ভাইয়ের ফেসবুক ওয়ালে রেজা ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদটি দেখে আমি হতাশ হয়ে পড়ি। কারণ প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ফেসবুকে কত মৃত্যু সংবাদ দেখি, দেশ-বিদেশে কত আপনজন, পরিচিতজন অবেলায় চলে যাচ্ছেন। এই তো কিছুদিন হয় তরতাজা প্রাণ সাংবাদিক আবেদ, ব্যবসায়ী রেন্টু চলে গেলেন। সাংবাদিক রেজা ভাইও চলে গেলেন।
এখন ফেসবুকে ঢুকতে ভয় লাগে- না জানি কার মৃত্যু সংবাদ পাই। এমনও মনে হয় যেন মৃত্যু আমাদের তাড়া করছে। সাবেরীন ভাই বর্তমানে আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। কবিতা লেখতেন, দৈনিক ভোরের কাগজে সুনামগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন, পরে কলেজে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান এবং সর্বশেষ পরিবার নিয়ে পাড়ি জমান মার্কিন মুলুকে। রেজা ভাই সাবেরীন ভাইয়ের মামা। তিনি তার ওয়ালে ছবিসহ একটি পোস্ট দেন। আমি যখন দেখি তখন সব কিছু শেষ জানাজা, দাফন। মনে মনে খুব আফসোস করি এবং অপরাধ বোধেও ভোগী। কারণ যে মানুষটির সঙ্গে দীর্ঘ দিন ধরে একসাথে চলেছি, তাঁর কাছ থেকে সাংবাদিকতায় অনেক কিছু শিখেছি আর তাঁর শেষ বিদায়ে তার মুখখানি দেখার, তার নামাজে জানাজা ও দাফনে শরিক হতে পারি নি – এই ভেবে খুব কষ্ট পাই। আর রেজা ভাইয়ের হাসিমাখা মুখ দেখা হবে না।
রেজা ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় সম্ভবত আশির দশকে। আমি ১৯৮৪ সালে এসএসসি পরীক্ষা শেষ করে সাংবাদিকতার অঙ্গনে পা রাখি। সিলেটের প্রখ্যাত সাংবাদিক প্রয়াত মহিউদ্দিন শীরু সম্পাদিত সাপ্তাহিক গ্রাম সুরমা পত্রিকার মাধ্যমে আমি লেখালেখি শুরু করি। আস্তে আস্তে পরিচয় হয় সাংবাদিক রণেন্দ্র তালুকদার পিংকুর (বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী) সাথে। তার মাধ্যমে রেজা ভাইয়ের সাথে পরিচয় এবং রেজা ভাইর সুরমা মার্কেটের সাপ্তাহিক সুনামগঞ্জ পত্রিকা অফিসে নিয়মিত যাতায়াত।
আরও পরিচয় হয় সাংবাদিক ফখরু কাজী ভাই, ম ফ র ফোরকান ভাই, চন্দন দা, এন এম রণধীর দাস ননী দা, নিরঞ্জন দা, প্রয়াত রেজাউল করিম মঞ্জু ভাই, প্রয়াত শাহজাহান কবির আফিন্দী ভাই, প্রয়াত আবুল কালাম ভাই ও আতিকুর রহমান আতিকসহ অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে।
রেজা ভাই খুব আদর করতেন, ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলার জন্য ও সংবাদ সংগ্রহের জন্য পাঠাতেন আমাদের। সাংবাদিকতার তালিম দিতেন, অনেক ভুল করলেও রাগ করতেন না, হাসি মুখে বুঝিয়ে দিতেন। একটি নিউজ নামে ছাপানোর জন্য অনেক অনুনয়-বিনয় করতাম। জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা, প্রেসক্লাবের সদস্য হতে কত অনুরোধ। এখন এগুলো কেবলই স্মৃতি।
রেজা ভাই একসময় সাংবাদিকতার জগত ছেড়ে ফার্মেসি ব্যবসায় ও অন্যান্য কাজে মনোনিবেশ করেন। এক সময় বাচ্চাদের আরও ভাল স্কুলে পড়াশোনা করাতে পরিবার নিয়ে সিলেট বসবাস করছিলেন। আমাদের সাথে যোগাযোগ বা দেখা ছিল না অনেক দিন। আমার সাথে সর্বশেষ দেখা হয়েছে সুনামগঞ্জের পৌরবিপণিতে। পৌর বিপণিতে সাংবাদিকদের আড্ডা জমে। রেজা ভাই সুনামগঞ্জের উত্তর পাড়ে অর্থাৎ সুরমা নদীর অপর পাড়ে কোন এক জায়গায় বিশাল জায়গা নিয়ে বিভিন্ন জাতের বনজ, ফলজ ও ওষধি গাছ লাগিয়ে বাগান করেন। তার বাগান নিয়ে কি একটা সমস্যা হলে সাংবাদিকদের দ্বারস্থ হন সংবাদ প্রকাশের জন্য। বর্তমান প্রজন্মের সাংবাদিকরা অনেকেই রেজা ভাইকে চিনেনা, তাই তাকে খুব একটা পাত্তা দিচ্ছিল না। এমন সময় আমি গিয়ে উপস্থিত। রেজা ভাইর সাথে কুশলাদি বিনিময় শেষে কাজের কথা বললেন। আমি তখন রেজা ভাইর অতীত ইতিহাস সব বলি এবং সহযোগিতা করার জন্য সহকর্মীদের বলি। রেজা ভাইকে আমি যেভাবে উপস্থাপন করি এতে উনি খুব পুলকিত হন। পরে অবশ্য রেজা ভাইয়ের সংবাদটি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
মহান আল্লাহ যেন রেজা ভাইকে জান্নাত দান করেন, তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারকে যেন শোক সইবার ধৈর্য্য দান করেন – এ দোয়া করি।
[লতিফুর রহমান রাজু, সভাপতি, সুনামগঞ্জ রিপোর্টার্স ইউনিটি]