বিশেষ প্রতিনিধি ::
সুনামগঞ্জে বোরো ধান ও চাল সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত সাড়ে ৩ মাসে লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও এখনো অর্জিত হয়নি। তবে এই ধানও কৃষকদের নাম ভাঙিয়ে ফড়িয়া ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা দিয়েছে বলে অভিযোগ আছে। ধান দিতে এসে ফড়িয়াদের উৎপাত, সময় মতো ধান সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু না করা, ইউনিয়ন পর্যায়ে গুদাম না থাকা, সরকারি গুদামে এনে ধান দিতে কৃষকদের যোগাযোগ বিড়ম্বনা, অতিরিক্ত সময় ও খরচ এবং ধানের সরকারি মূল্য কম থাকার কারণে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সংগ্রহ হবে না বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। ৩১ আগস্ট ধান-চাল সংগ্রহ কার্যক্রম শেষ হচ্ছে।
সুনামগঞ্জ কৃষি বিভাগের মতে চলতি বোরো মওসুমে সুনামগঞ্জ জেলায় বাম্পার ফলন হয়েছে। করোনার মধ্যেও শিলাবৃষ্টি-বন্যার ক্ষতি ছাড়াই পুরো ধান কেটে গোলায় তুলেছেন কৃষক। জেলায় এ বছর ২ লাখ ১৯ হাজার ৩০০ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হয়েছে। সরকারি হিসেবে এই ধান থেকে প্রায় ১৩ লক্ষ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হবে। যার সাড়ে ৫ লক্ষ মেট্রিক টন চাহিদা পূরণ করে বাকি ৮ লক্ষ মে.টন উদ্বৃত্ত আছে। খাদ্য বিভাগের সংশ্লিষ্টরা বলছেন করোনার কারণে ধান-চাল সংগ্রহ কার্যক্রম বিলম্বিত হয়েছে। তবে এখন ধান ও চাল বাজারে দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হবার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে ধান সংগ্রহ করার নির্দেশনা ছিল। কিন্তু কৃষকের তালিকা তৈরিতে বিলম্ব, জটিলতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে সময়মতো ধান সংগ্রহ সম্ভব হয়নি বলে অভিযোগ আছে। এই সময় ধান সংগ্রহ শুরু হলে লক্ষ্যমাত্রা পূরণের সুযোগ থাকতো বলে সুধীজন জানিয়েছেন। তাছাড়া ধান কাটার পর কৃষকের হাত খালি থাকায় তারা সস্তায় খোরাকির অবশিষ্ট ধান বিক্রি করে দিয়েছেন। অন্যদিকে মে মাস থেকেই ভৈরব, নরসিংদী, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন এলাকার মহাজনরা বড় বড় নৌকা নিয়ে হাওরাঞ্চলে এসে সস্তায় ধান কিনে নিয়ে গেছে। এর পাশাপাশি স্থানীয় ফড়িয়া চক্রও কৃষকের কার্ড সংগ্রহ করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের কাছ থেকেও কৌশলে ধান কিনে রেখেছে। এখন এই ফড়িয়ারাই কৃষকের নাম ভাঙিয়ে খাদ্যগুদামে ধান দিচ্ছে এমন অভিযোগ আছে। কৃষকের কাছে ধান না থাকায় এখন ফড়িয়ারাই সুযোগ নিচ্ছে। তাছাড়া যথাসময়ে চাল সংগ্রহ শুরু না হওয়ায় চালও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী পূরণ হবে না বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সুনামগঞ্জ খাদ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বোরো মওসুমে বাম্পার ফলন হওয়ায় খাদ্য মন্ত্রণালয় এবার অন্যান্য বছরের তুলনায় ধানসংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। সুনামগঞ্জে দুই দফা ৩২ হাজার ৬৬৪ মে.টন ধান সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ১৭ আগস্ট পর্যন্ত সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ১৫ হাজার ২৪১ মে.টন। চাল ১৪ হাজার ৬৮৭ মে.টন (সিদ্ধ) এর মধ্যে সংগ্রহ হয়েছে ৩ হাজার ৬১৫ মে.টন। আতপ চাল সংগ্রহ হয়েছে ১৪ হাজার ২৮ টনের মধ্যে মাত্র ৭ হাজার ৫০৭ মে.টন। ধান-চাল কোনটাই এখনো অর্ধেকও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। এই মাসের শেষেই কার্যক্রম সমাপ্ত হচ্ছে। বাজারে ধান চালের দাম বৃদ্ধির কারণে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা এখন আর ধান চাল দিতে তেমন আগ্রহী নয় বলে জানা গেছে।
হাওর আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ধানসংগ্রহ কার্যক্রমে ত্রুটি, ইউনিয়ন পর্যায় থেকে সংগ্রহ না করা, সংগ্রহে বিলম্ব ও কৃষকের চাহিদা প্রতিফলিত না হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। তাছাড়া বাইরের পাইকাররা হাওরের কৃষকদের কাছ থেকে অনেক আগেই ধান কিনে নিয়ে গেছে।
শাল্লা উপজেলার কৃষক সংহতির আহ্বায়ক পীযুষ দাস বলেন, এবার হাওরে বাম্পার ফলন হয়েছে। আমরা ফলনে খুশি। তবে জরুরি প্রয়োজনে ঋণগ্রস্ত কৃষক অনেক আগেই ধান বিক্রি করে দিয়েছেন। তাছাড়া কিছুদিন আগে জেলার বাইরের পাইকাররা বড় বড় নৌকা নিয়ে ধান কিনেছেন। এখন আর কৃষকের হাতে ধান নেই। স্থানীয় কিছু ফড়িয়া কৃষকের কার্ড সংগ্রহ করে আগের জমানো ধান গুদামে ধান দিচ্ছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। আমাদের স্থানীয় গুদামগুলোতে চালও পর্যাপ্ত সংগ্রহ সম্ভব হচ্ছে না।
হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি প্রফেসর চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, গলদ রয়েছে ধানসংগ্রহ নীতিমালায়। আমরা স্মারকলিপি দিয়েছিলাম ইউনিয়ন পর্যায় থেকে কৃষকের ধান উপযুক্ত সময়ে সংগ্রহ করার জন্য। সেটা যতদিন হবেনা ততদিন সরকারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। আমাদের হাওরের যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্গমতার কারণেও কৃষকরে গুদামে এসে ধান দেওয়ার সুযোগ নেই।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. জাকারিয়া মোস্তফা বলেন, করোনার কারণে ধান চাল সংগ্রহ বিলম্ব হয়েছে। এখন বাজারে দুটোর দামই বাড়তি। তাই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।