প্রয়াত সাংবাদিক আবেদ মাহমুদ চৌধুরীকে ‘ভাই’ সম্বোধন করতাম। বছর দুয়েক আগে একদিন বলেলেন, ‘তুমি তো বেটা আমার ভাগনা লাগো? ভাই ডাক খেনে?’
জানতে চাইলাম, ‘কিলা?’
– তোমার ওয়াইফের খালতো ভাই মানিক আমার ভাগনা লাগে। তে তো তুমিও আমার ভাগনা।
– ঠিক আছে ভাই, এখন থাকি আফনে আমার মামু।
শুরুর দিকে আড্ডায় মজা করে প্রায়ই বলতাম, ‘আবেদ ভাই আমার মামু’ যেমনটা বলি ‘সাংবাদিক মাসুক ভাই আমার দামান’।
একটা পর্যায়ে এসে ‘মামু’ ডাকে অভ্যস্ত হয়ে যাই, আর উনি ভাগনায়। এক্ষেত্রে কেবল আমিই নই, সহকর্মীদের একটি বড় অংশই সম্পর্কে উনার হয় ভাগিনা, না হয় ভাতিজা। ভাগিনা হওয়ার পর ‘আপনি’ থেকে তুমিতে নেমে আসি; তিনও কখনো তুমি, কখনো বা তুই সম্বোধন করতেন।
ঘনিষ্ঠতা বাড়ার সাথে সাথে অগ্রজ সহকর্মীর সাথে অনুজের সম্পর্কের মাঝখানে যে ‘তফাত’টা থাকে, আমাদের ক্ষেত্রে ক্রমেই সেটা দূর হয়ে যায়। একটি হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই হৃদ্যতার মাঝেও ‘মধুর লাগালাগি’ অব্যাহত ছিল। তাঁর বিপক্ষে ‘লাগালাগির’ একটা টিমই ছিল বলা যায়; যার সম্মুখভাগে মাহবুব ভাই, মহিম ভাই, আমি, এমরান, মিসবাহ, জাকির, শহীদনূর প্রমুখ।
‘লাগালাগির’ কেন্দ্রে ছিল আবেদ মামুর সম্পাদনায় প্রকাশিত স্থানীয় একটি সাপ্তাহিক। কাগজে প্রকাশিত লেখার ছোট-খাট ভুল ধরে ‘খাউরি’ দিতাম আমরা। পত্রিকাটি প্রকাশের শুরুর দিকের সংখ্যাগুলোতে খানিকটা টাইপিং মিসটেক হতো। এবং মিসটেকগুলো ছিল বেশ মজার!
যেমন, ‘ছাতকে সৌন্দর্য্য বর্জনে এগিয়ে আসার আহবান’… ছাপাখানার ভূতের আছরে ‘বর্ধন’ যখন ‘বর্জন’ এ রূপ নেয়, বন্ধু-বন্ধব আর ভাগনাকূল কী আর তখন বসে থাকে? এ নিয়ে নিয়ে সবাই ¯্রফে মজা করতাম, সেখানে কোন তাচ্ছিল্য ছিল না। আমরা যে মজা করতাম, নানাভাবে সেটি তাঁর কানেও যেত!
বলতেন, ‘ফুয়াইন, আমারে লইয়া খাউরি খাও… পত্রিকা বার খইরা দেখ কিলা লাগে!’
মিথ্যা বলতাম।
– ইয়া মামু, তোমারে লাইয়া আমরা মজা খরমু। বিশ্বাস খর কিলা?
গত বুধবার (২২ জুলাই) প্রিয় আবেদ মামুর আকস্মিক মৃত্যুর খবর শোনে হতবিহ্বল হয়ে যাই। ২৪ ঘণ্টা আগেও একসাথে সড়ক দুর্ঘটনার নিউজ কভার করেছি। উনি যখন টিভিতে লাইভ করছিলেন, চোখাচোখি হয়েছে। তাঁর চলে যাওয়া পর থেকে কত স্মৃতি ভাসছে মনের আয়নায়। কোনটা রেখে কোনটা লিখি; অসুস্থ হয়ে মধ্যরাতে পুলিশের সহায়তায় হাসপাতাল ভর্তি হওয়ার ঘটনা, অফিসে রসুন খাওয়া… কত কি…।
আবেদ মামুর মৃত্যুর পর যে বিষয়টি মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, সেটি হচ্ছে, মৃত্যুর পর মানুষের ভাল দিকগুলো দিনের আলোর মতো ভেসে ওঠে। আপনজনের জীবদ্দশায় যদি তাকে এইভাবে পড়া যেত; মানুষের প্রতি মানুষের হিংসা-বিদ্বেষ অনেকাংশেই কমে যেতো। প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হয়ে যেতো ভুবন।
আবেদ মাহমুদের সরলতাকে আজ আমরা মিস করছি। জীবদ্দশায় সেই সারল্যটা পড়তে পারলে তাঁর প্রতি আরো শ্রদ্ধাশীল হতে পারতাম। একজন ভাল মানুষকে চিনতে দেরি করার অনুতাপ নিয়ে আজ তাঁকে নিয়ে লিখতে বসেছি যেন। সুনামগঞ্জে সাংবাদিকতা অঙ্গন একজন প্রতিশ্রুতিশীল সহকর্মীকে অকালে হারানোর শূন্যস্থান সহজে পূরণ করতে পারবে না। আবেদ মাহমুদ চৌধুরীর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতের মেহমান হিসেবে কবুল করুন। তাঁর অবুঝ দুটি মেয়েকে পিতা হারানোর সীমাহীন কষ্টের সময়টাতে ধৈর্য্য ধরার তৌফিক দিন। আমিন।