বিকি বিল। এইতো কয়েক বছর আগেও তেমন কেউ চিনতো না, এখন প্রায় সব ভ্রমণপিয়াসীরাই চিনেন সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার উত্তর বড়দল ইউনিয়নের কাশতাল গ্রামের বিকি বিলকে। শরতে অজস্র রাশি রাশি লাল শাপলা আর পাশে বিশাল সুউচ্চ মেঘালয়ের পাহাড় সারি। সকাল বেলায় এই বিলের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য্য বলে বুঝানো যাবে না। এই তো মাসখানেক পরই একটা-দুইটা করে ফুল ফুটা শুরু হবে। একদম জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে। তবে অক্টোবরে একটু বেশিই থাকে ফুল। আস্তে আস্তে পানি শুকিয়ে যায়, শাপলাও বিলীন হয়ে যায় সাথে সাথে। বছরের প্রথম বৃষ্টির সাথে সাথে পুরনো টিউবার থেকে আবার গাছ উঠে। প্রায় ৬ মাস থাকে শাপলার সৌন্দর্য্য।
মানুষজন দেশের একোণা ওকোণা থেকে এসে ভিড় করবে শাপলা দেখার জন্য। ভোর বেলা নৌকা নিয়ে ঘুরবেন আর আসার সময় কয়েকটা ফুল কেউ কেউ নিয়ে আসবেন। সুনামগঞ্জের নতুন এই পর্যটন স্পট খণ্ডকালীনভাবে হলেও কিছু মাঝির জন্য কিছুদিনের আর্থিক সুবিধা দেয়। সুনামগঞ্জের মত প্রায় সব হাওর এলাকায় সাধারণত পানি শুকানোর সাথে সাথে ধান বোনা হয়। আমন ধান।
কিন্তু ভরা বর্ষায় কৃষকের কিছু করার থাকে না একমাত্র মাছ ধরা ছাড়া। এমন কৃষকও আছেন যিনি শাপলার শালুক সংগ্রহ করেন আর দিন শেষে তাই তার খোরাক হয়। তাই বিলে পর্যটকের শাপলা দর্শন আর কৃষকের শাপলা দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদাই বটে।
শাপলা যে শুধু বিকি বিলেই হয় তা কিন্তু না। গত বছর গিয়েছিলাম বরিশাল থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে, উজিরপুরে। ওখানে সাতলা নামের এক গ্রাম আছে, যেখানে প্রায় ২০০ একর জুড়ে রাশি রাশি শাপলার মেলা। সাতলা গ্রামের নামেই তার নাম সাতলার বিল। হয়তো নেই পাহাড়। কিন্তু এ বলে পর্যটক থেমে নেই। মজার ব্যাপার হলো ওখানে কাউকে দেখলাম না শাপলা নিয়ে আসতে, নিজে নিতে চাইলেও মাঝি আমাকে বিরক্ত হয়েই মানা করলেন। পরক্ষণেই জানা গেল অন্য কথা। শাপলার এই সময়ে ওখানে মাছের চাষ করেন আর সাথে সাথে করেন মৌমাছি চাষ। প্রায় ৩ প্রজাতির মৌমাছি চাষ করা হয় এখানে এবং বছর শেষে প্রায় ৫০/৬০ লিটার মধু পাওয়া গেছে সাতলা থেকে।
মৌমাছি পৃথিবীতে সবচেয়ে উপকারী পতঙ্গের একটি। মৌমাছি না থাকলে হয়তো থাকবে না মানুষের অস্তিত্ব। মৌমাছি এক ফুল থেকে অন্য ফুলে মধু আহরণ করে, সাথে ঘটায় পরাগায়ণ। পরাগায়ণ না হলে মানুষের খাদ্য তালিকার প্রায় এক তৃতীয়াংশ অপূর্ণ থাকতো। ধান, গমসহ সব ধরনের খাদ্য শস্যই পরাগায়ণ ছাড়া সম্ভব না। এছাড়া ফল বা অন্য বীজধারী গাছের কথা না হয় বাদই দিলাম।
শিশু জন্মের পরেই তাকে মধু খাওয়ানো হয়, মধু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এছাড়া মধুর অনেক ধরনের ব্যবহার আর ঔষধি গুণাগুণ আছে। এই বিকি বিলের মত সবগুলো পর্যটন ক্ষেত্রই হলো বিপুল সম্ভাবনাময় জায়গা। একই সাথে অর্থনৈতিক, সেই সাথে প্রকৃতিবান্ধব। যে জমিতে ৬ মাস শাপলা থাকে ওই জমিতে চাইলেই মধু চাষ করা যায়।
কৃষক লাভবান হবে, একই সাথে জমিতে কীটনাশকের ব্যবহার কমবে, প্রকৃতি দূষণের হাত থেকে বাঁচবে, কীটনাশক ব্যবহারে মাছের প্রজননে যে ক্ষতি হতো তাও হবে না। প্রশাসনিক হোক আর ব্যক্তি উদ্যোগই হোক, সদিচ্ছাই পারে এই ধরনের সম্ভাবনাময় ব্যাপারকে বাস্তবে রূপ দিতে।