প্রতিদিন পত্রিকায় সরকারের উচ্চপদে আসীনজন কিংবা বলা উচিত দেশ-রাষ্ট্র-সমাজ পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণে বর্তমানে যাঁরা মুখ্য ভূমিকা পালন করছেন তাদের বিভিন্ন মন্তব্য প্রকাশিত হয় এবং দেশের সাধারণ মানুষ চমৎকৃত হওয়ার চেয়ে বেশি আশান্বিত হন। তাঁরা ভাবেন তাঁদের জীবনে এই বুঝি সুদিন আসছে, নিত্যদিনের অনিয়ম, অত্যাচার, নির্যাতন, অভাব-অনটন, দুর্ভোগের সীমাহীন লাঞ্ছনা থেকে বুঝি এবার মুক্তি মিলবে।
গতকালের পত্রিকা থেকে কয়েকটি মন্তব্য উদ্ধৃত করছি : সবাই একযোগে কাজ করে সোনার বাংলা গড়বো, অন্যায় করলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা বিশ্বের ইতিহাসে বিস্ময়, শিক্ষার উন্নয়নে বর্তমান সরকার নিরলসভাবে কাজ করছে, দেশকে দুর্নীতি মাদক ও জঙ্গিমুক্ত করতে হবে, বঙ্গন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন হলেই দেশ উন্নত হবে। এই মন্তব্যগুলোর প্রত্যেকটির ভেতরে দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনীতিক পরিবর্তনের গভীর ইঙ্গিত আছে, কিন্তু সেই ইঙ্গিতানুসারে রাজনীতিক কাজ পরিচালিত হচ্ছে না। বর্তমান সরকারের সদিচ্ছা আছে, ‘বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন হলেই দেশ উন্নত হবে’ এবং ‘সবাই একযোগে কাজ করে সোনার বাংলা গড়বো’ এ সবই ঠিক আছে, কিন্তু সে অনুসারে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার কর্মসূচি আপাতত বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনুপস্থিত। সকলেই জানেন, বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে, বঙ্গবন্ধু তাঁর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন পূরণের পথে হাঁটতে শুরু করেছিলেন অনমনীয় মনোভাব নিয়ে সুদৃঢ় পদক্ষেপে, অর্থাৎ তিনি দেশকে নিশ্চিত শোষণমুক্তির দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়ার কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু দেশিবিদেশি পুঁজিবাদী শোষকশ্রেণি ও সা¤্রাজ্যবাদীশক্তি তাঁকে বাঁচতে দেয়নি এবং তাঁরা ক্ষমতা দখল করে দেশের গতিমুখ পাল্টে দিয়ে দেশকে আজকের অবস্থায় নিয়ে এসেছে, যে-অবস্থা, কিংবা বলা ভালো, অসহনীয় দুর্ভোগ থেকে মুক্তির জন্যে সরকার ও রাষ্ট্র পরিচালকরা এতোসব মন্তব্য কিংবা চিন্তাভাবনা করছেন। তাঁদের এই চিন্তাভাবনা চিন্তা ও ভাবনার আকারেই থেকে যেতে বাধ্য হবে যদি না বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর আগে যে-আর্থসামাজিক ব্যবস্থা গড়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন সেটাকে বাস্তবায়িত করা না যায়। ভুলে গেলে চলবে না যে, সেই উদ্যোগকে থামিয়ে দেওয়ার প্রয়োজনে স্বাধীন বাংলাদেশের শত্রুরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পর্যন্ত দ্বিধা করেনি। আজ সেই ১৯৭৫-য়ে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক পরিকল্পিত উদ্যোগকে যারপরনাই দৃঢ়তার সঙ্গে অনুসরণ করে বর্তমানের আর্থসামাজিক পরিপ্রেক্ষিতের বিবেচনায় প্রয়োজনে পরিমার্জিত করে বাস্তবায়িত করতে হবে, অন্যথায় রাষ্ট্র পরিচালকদের সকল কথা শেষ পর্যন্ত হাস্যকরভাবে অকার্যকর বলে প্রতিপন্ন হবে, বাস্তবায়নে অবশ্যই দ্বিধা করলে চলবে না। মনে রাখতে হবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে কিন্তু শত্রুরা কোনও দ্বিধা করেনি। সেদিন তারা আসলে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে স্বাধীন বাংলাদেশকেই হত্যা করেছিল, অর্থাৎ যুদ্ধ করে অর্জিত স্বাধীনতাকে অর্থহীন করে দিয়েছিল।
পরিশেষে বলার কথা একটাই, কথার ফুলঝুরিতে কোনও কাজ হবে না, বাংলাদেশকে কাজে নামতে হবে এবং কাজে নামার আগে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কাছে, তাঁর সর্বশেষ কর্মসূচির কাছে ফিরে যেতে হবে। যে-কর্মসূচি দেশি-বিদেশি শোষকরা কার্যকর হতে দেয়নি বা কার্যকর করতে দেয়নি।