বিশেষ প্রতিনিধি ::
সরকার কর্তৃক প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ ঘোষিত হওয়ার ৫ মাসের মাথায় তাহিরপুর সীমান্তের প্রাচীন লাউড় রাজ্যের ঐতিহাসিক হলহলিয়া (হাওলি) দুর্গ দ্বিতীয় দফা খনন ও অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের উদ্যোগে খনন ও অনুসন্ধান কাজের উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত বছরের নভেম্বরে প্রথম দফা খনন কাজ শুরুর পর এখানে বাংলার প্রাচীন রাজধানী লাউড়ের বিশাল দুর্গের সন্ধান পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টদের ধারণা এই দুর্গতে প্রত্নতাত্ত্বিক নানা নিদর্শন, সেই সময়ের জীবন-জীবিকা ও একাধিক সভ্যতার নানা উপকরণ এবং যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ স্মারক পাওয়া যেতে পারে। এখানে কয়েকটি যুগের সভ্যতা বিদ্যমান রয়েছে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সেগুলো খুঁজে বের করে বাংলার প্রাচীন সভ্যতাকে তুলে আনতে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর দ্বিতীয় দফা খনন ও অনুসন্ধানের কাজ শুরু করেছে। এখন থেকে নিয়মিত খনন ও অনুসন্ধান চলবে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর চট্টগ্রাম-সিলেট অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক ড. মো. আতাউর রহমানের নেতৃত্বে এই কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, তাহিরপুর উপজেলার খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে ও যাদুকাটা নদীর পশ্চিম পাশে অবস্থিত হলহলিয়া। এখানে প্রায় ৭শ বছরের পুরনো পুরাকীর্তি রয়েছে। কিন্তু সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে উপরিভাগের অনেক মূল্যবান প্রত্ন উপকরণ হারিয়ে গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, লাউড় রাজ্য পৌরাণিক যুগের রাজ্য। এর স্থপতি রাজা ভগদত্ত। ভগদত্তের ১৯ জন বংশধর সিলেটের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে রাজ্য স্থাপন করে রাজত্ব করেন। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে প্রাচীন লাউড় রাজ্য কামরূপ রাজ্য থেকে আলাদা হয়। দশম শতক থেকে স্বাধীনভাবে রাজ্য শাসন শুরু হয়। ঐতিহাসিকদের মতে বর্তমানে সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও ময়মনসিংহ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল লাউড় রাজ্য। মহাভারতের যুদ্ধে অর্জুনের পক্ষে লড়তে গিয়ে নিহত হন রাজা ভগদত্ত। অর্জুনের পক্ষে সৈন্য সামন্ত পাঠিয়েছিলেন লাউড়ের রাজা ভগদত্ত। দ্বাদশ শতাব্দীতে রাজা বিজয় মাণিক্য লাউড় রাজ্য পরিচালনা করেন। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষে তিনি সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরেও রাজ্য স্থাপন করেন বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। এসময় বঙ্গের ব্রাহ্মণরা বল্লাল সেন কর্তৃক নির্যাতিত হয়ে রাজা বিজয় মাণিক্যের রাজ্যে আশ্রয় নেন। তিনি তাদের উদার হস্তে আশ্রয় দিয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তবে বিজয় মাণিক্যের পরে কারা লাউড় শাসন করেন ইতিহাসে তা এখনো অজানা রয়ে গেছে। তবে বিজয় মাণিক্যের সময়ে অনেক গুণীজন পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন বলে জানা যায়। প্রাচীন ইতিহাসে লাউড় রাজ্য সব সময় স্বাধীন ছিল বলে ঐতিহাসিকদের মত।
জানা গেছে, সুনামগঞ্জের কৃতী সন্তান বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)’র চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে সুনামগঞ্জের এই ঐতিহাসিক স্থাপনা সংরক্ষণ ও ইতিহাস সংরক্ষণের স্বার্থে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের লিখিত আবেদন জানান। ড. মোহাম্মদ সাদিক তাঁর পত্রে উল্লেখ করেছিলেন, সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় প্রাচীন লাউড় রাজ্যের রাজধানী ছিল। লাউড়ের রাজা ভগদত্ত মহাভারতের যুদ্ধে অর্জুনকে সৈন্য পাঠিয়ে সাহায্য করেছিলেন। মহাভারতের প্রথম বাংলা অনুবাদকারী মহাকবি সঞ্জয়ও ওই এলাকার বাসিন্দা। সাধক শাহ জালালের সঙ্গী শাহ আরেফিন, মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যের প্রধান সহচর শ্রী অদ্বৈতাচার্য্যরে বাড়িও এখানে। ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি মূল্যবান নিদর্শনের এই এলাকাকে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রক্রতত্ত্ব বিভাগের মাধ্যমে ইতিহাসের নতুন দিগন্ত উন্মোচনের আহ্বান জানিয়েছিলেন ড. মোহাম্মদ সাদিক।
গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় হলহলিয়া (হাওলি) দুর্গ ও রাজবাড়িকে প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে। ফলে বাংলার ঐতিহাস, ঐতিহ্য ও সভ্যতা উন্মোচনের লক্ষ্যে স্থায়ী খনন, গবেষণা ও অনুসন্ধানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। প্রথম দফা খননের পর বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দফা খননের সঙ্গে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানও শুরু হয়েছে।
প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও অনুসন্ধান কার্যক্রম উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর চট্টগ্রাম-সিলেট অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক ড. মো. আতাউর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল, তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বীরেন ব্যানার্জী, ময়নামতি জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান মো. হাফিজুর রহমান, ফিল্ড অফিসার শাহিন আলম প্রমুখ।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর চট্টগ্রাম-সিলেট অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক ড. মো. আতাউর রহমান বলেন, সিলেট একটি প্রাচীন জনপদ। এই প্রাচীন নগরভিত্তিক জনপদের উৎপত্তি হিসেবে লাউড়েরগড় ছিল প্রাচীন রাজধানী। এখানে সঠিকভাবে গবেষণা ও খননের মাধ্যমে সঠিক ইতিহাস উদঘাটন করা সম্ভব হবে। এর মাধ্যমে এই অঞ্চলে একটি প্রত্ন-পর্যটন নগরী গড়ে উঠবে। তিনি বলেন, গত বছর প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ হিসেবে হলহলিয়া ঘোষিত হওয়ায় এখন খনন ও গবেষণায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। আমরা দীর্ঘ মেয়াদী খনন ও গবেষণা চালাতে পারব। তবে প্রথম দফা খননেই আমাদের মনে হয়েছে এখানে লাউড় সভ্যতার আগেও অন্য সভ্যতা ছিল। মেঘালয়ের পাদদেশের এই স্থানে এক সভ্যতার ওপর আরেক সভ্যতা গড়ে ওঠেছে। কয়েকটি সভ্যতার নিদর্শন এখান থেকে পাওয়া সম্ভব। এবারের খননে দুর্গ থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক নানা উপকরণ ও যুদ্ধের স্মারক পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
খননকারীরা দল জানিয়েছেন প্রথমে হলহলিয়া দুর্গের প্রধান ফটকের পূর্ব দিকের প্রাচীরের দক্ষিণ অংশ থেকে খনন শুরু হয়। প্রধান ফটক থেকে দুর্গটি উত্তর-দক্ষিণে গেছে। প্রাচীরের উপরের অংশ পাথর দিয়ে মোড়ানো। দেখে বুঝার উপায় নেই এর নিচে কিছু থাকতে পারে। কিন্তু খননদল সেখান থেকেই খনন করে সেগুলো সরিয়ে নিচের দিকে কিছু দূর খনন করার পরই পাওয়া গিয়েছিল ৫০০ বছর আগের পুরনো রঙিন ও অক্ষত অনেকগুলো ইট।