বিশেষ প্রতিনিধি ::
দিরাইয়ে বহুল আলোচিত শিশু তুহিন মিয়া হত্যাকাণ্ডের অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেছে পুলিশ। সোমবার আদালতে তুহিনের বাবা আব্দুল বাছির, চাচা জমসেদ, নাছির, মাওলানা মোছাব্বির ও চাচাতো ভাই সাহারুল ওরফে শাহরিয়ারকে অভিযুক্ত করে এ অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। সাহারুলের বয়স ১৮ বছরের কম হওয়ায় শিশু আদালতে তার অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।
গত ১৩ অক্টোবর রাতে দিরাই উপজেলার রাজানগর ইউনিয়নের কেজাউড়া গ্রামে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। পরের দিন সকালে বাড়ির পাশের একটি গাছে ঝুলন্ত অবস্থায় তুহিনের রক্তাক্ত লাশ পাওয়া যায়। তুহিনের গলা, কান ও যৌনাঙ্গ কাটা ছিল। পেটে বিদ্ধ ছিল দুটি ছুরি।
অভিযোগপত্র দাখিল শেষে দুপুর সাড়ে ১২টায় পুলিশ সুপার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান জানান, হত্যাকাণ্ডের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার প্রমাণসহ তাদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট প্রদান করা হয়েছে। আদালত চার্জশিট আমলে নিয়েছেন। প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে ও প্রতিবেশীদের সমর্থন পেতে নির্মমভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়।
পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান আরো বলেন, গত ১৪ অক্টোবর ভোরে দিরাই উপজেলার রাজানগর ইউনিয়নের কেজাউড়া গ্রামে আব্দুল বাছিরের ছেলে তুহিন মিয়াকে নৃশংসভাবে খুনের ঘটনা জানতে পারে পুলিশ। পরে তুহিনের লাশটি উদ্ধার করা হয়। সেই সময় তুহিনের বাবা, তিন চাচা, চাচাতো ভাই, চাচি ও চাচাতো বোনসহ সাতজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়। তুহিন হত্যায় অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করে থানায় মামলা দায়ের করেন তুহিনের মা মনিরা বেগম। পরদিন আদালতে চাচা নাসির ও চাচাতো ভাই শাহরিয়ার ১৬৪ ধারায় হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
পুলিশ সুপার আরো জানান, গ্রাম্যকোন্দল, মামলা-মোকদ্দামার জেরে গ্রামের সাবেক ইউপি মেম্বার আনোয়ারের লোকদের সঙ্গে ২০০০ সাল থেকে বিরোধ ছিল তুহিনের পরিবারের। ২০০২ সালে গ্রামে একটি হত্যাকাণ্ড হয়। যা মুজিব হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত। তুহিনের বাবা বাছির এই মামলার আসামি ছিলেন। এই ঘটনার জেরে দুই পক্ষের মধ্যে একাধিক মামলা হয়। সর্বশেষ ২০১৫ সালের দিকে তুহিনের বাবা আব্দুল বাছিরের বেয়াই জবর আলীর মেয়ে নিলুফাকে হত্যা করা হয়। নিলুফা হত্যার আসামি ছিলেন তুহিনের বাপ-চাচাদের প্রতিপক্ষ আনোয়ার মেম্বারের গোষ্ঠীর ১৫-১৬ জন। ওই মামলার সাক্ষী ছিল তুহিনের চাচা মোছাব্বির। বর্তমানে এই মামলা গ্রামের একজনের হস্তক্ষেপে জবর আলী আনোয়ার মেম্বারের সাথে বিরোধ মিমাংসা করার প্রক্রিয়া চলমান ছিল। তুহিনের বাবা বাছিরের বিরুদ্ধে মুুজিব হত্যায় যে মামলাটি চলছিল তার যুক্তিতর্ক শুনানির তারিখ ছিল ১৪ অক্টোবর। পুলিশ তদন্ত করতে গিয়ে জানতে পেরেছে, তুহিনের বাবা আশঙ্কা করছিলেন এই মামলায় হয়তো তার শাস্তি হয়ে যেতে পারে। প্রতিপক্ষের মামলা মিমাংসা ও নিজের মামলার শাস্তির আশঙ্কা থেকে প্রতিপক্ষকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে ৩ দিন আগে নিজ সন্তানকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেন বাছির। বাছির তার ভাই ও ভাতিজারা এই পরিকল্পনায় জড়িত ছিল। পরবর্তীতে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে হত্যাকাণ্ডের রাতে ঘর থেকে তুলে নিয়ে বাড়ির পাশে নৃশংসভাবে হত্যা করে গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয় তুহিনকে। এ সময় নৃশংসতা করতে গিয়ে অভিযুক্তরা সময় ক্ষেপন করে এবং হত্যায় ব্যবহৃত দুই ছুরিতে প্রতিপক্ষের সালাতুন ও সোলেমানের নাম লিখে রাখে। তদন্তে করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞদের দেয়া রিপোর্ট অনুযায়ী সালাতুল ও সোলেমানের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। তাদের রিপোর্ট আব্দুল বাছির ও তার ভাইদের বিরুদ্ধে বলে জানান পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান।
হত্যাকাণ্ডে তুহিনের বাবা আব্দুল বাছিরের সম্পৃক্ততা প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে পুলিশ সুপার বলেন, হত্যাকাণ্ডের রাতে বাবার সাথে একই খাটে শিশু তুহিন ঘুমিয়ে ছিল। বাবা ভিন্ন অন্য কেউ তুহিনকে বাইরে নিয়ে যাওয়া বাস্তবসম্মত নয়। বাবার কাছ থেকে কোনো সন্তানকে কেউ তুলে নিতে পারে – এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তুহিনের চাচা নাছির আদালতে যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে তাতে সে পরিষ্কারভাবে বলেছে এই হত্যাকাণ্ডে তুহিনের বাবা আব্দুল বাছির জড়িত।
হত্যাকাণ্ডে পরিবারের স্বজনদের এমন নৃশংসতার কারণ হিসেবে পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান জানান, ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে যা জানতে পেরেছি, হত্যাকাণ্ডে নৃশংসতার মূল কারণ জনমতকে পক্ষে নেয়া। প্রতিবেশীরা যাতে শিশুর মৃতদেহ দেখে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়, আক্রমণাত্মক হয়।