বিশেষ প্রতিনিধি ::
সুনামগঞ্জের জলমহাল ও হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের সমূহ কার্যক্রমের তথ্য ওয়েবপোর্টালে আপলোড করার নির্দেশ দিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত। শনিবার দুপুরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও স্থানীয় পর্যায়ে কর্মকর্তা-কর্মকর্তাবৃন্দের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি এই নির্দেশনা দেন। একই সঙ্গে সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের নির্মাণ ও সংস্কার কাজ দুদক মনিটরিং করবে বলে জানান তিনি। দুদকের বিভাগীয় পরিচালককে সিডিউল দেখে কাজের মান মনিটরিংয়ের নির্দেশও দেন তিনি।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন স্থানীয় সরকারের উপ-পরিচালক এমরান হোসেন, সুনামগঞ্জ পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান পিপিএম, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুর রহমান, হাওর বাঁচাও আন্দোলনের কার্যকরী সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান, সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায়, বীর মুক্তিযোদ্ধা মালেক হুসেন পীর, সুনামগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ শেরগুল আহমেদ, সাংবাদিক পংকজ কান্তি দে, শামস শামীম, মাসুম হেলাল, মাহতাব উদ্দিন তালুকদার, সেলিম আহমদ তালুকদার, হিমাদ্রী শেখর ভদ্র, জাসদ সেক্রেটারি এনামুজ্জামান চৌধুরী প্রমুখ।
হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা শতভাগ নিশ্চিত করতে সভায় মতামত তুলে ধরেন হাওর বাঁচাও আন্দোলনের কার্যকরী সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান, সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায়, সাংগঠনিক সম্পাদক মাসুম হেলাল।
এ সময় দুদক সচিব বলেন, বোরো ফসল হচ্ছে এই জেলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক উপাদান। এটি রক্ষায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের বিষয়টি প্রাধান্য দিতে হবে। কাবিটা নীতিমালা অনুযায়ী গণশুনানি করে প্রকল্প বাস্তাবায়ন কমিটি গঠন করতে হবে। প্রকল্পের প্রাক্কলন ও কাজ সম্পন্নের পর মাপজোক সাধারণ মানুষের উপস্থিতিতে নিতে হবে, যাতে কাজের ব্যাপারে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়।
দুদক সচিব আরো বলেন, প্রিওয়ার্কে নয়ছয় হয়েই থাকে। আমাদের অভিজ্ঞতায় এটা দেখেছি। তাই প্রিওয়ার্কের সময় স্থানীয় সুধীজন ও ভালো মানুষদের রাখার পরামর্শ দেন তিনি। একই সঙ্গে প্রিওয়ার্কের সকল তথ্য ওয়েবসাইটে আপলোডসহ তথ্য উন্মোচন করার নির্দেশনা দেন।
সাংবাদিক শামস শামীম তার বক্তব্যে বলেন, নিয়মিত প্রকল্পের বাইরে গিয়ে কয়েকজন এমপি ১১ কোটি টাকার ৫৩টি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছেন। এটি স্পষ্ট কাবিটা নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকারের উপ-পরিচালক মো. এমরান হোসেন বলেন, বিশেষ সুপারিশের প্রকল্পগুলো আমাদের কাছে আসলেও আমরা অনুমোদন দেইনি। যাচাই-বাছাই ও প্রিওয়ার্ক করে আমরা অনুমোদন দেওয়া যায় কিনা দেখব।
সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের একটি চক্র বছরের পর বছর ধরে সীমাহীন দুর্নীতি করে সেবাপ্রার্থী মানুষকে বঞ্চিত করছে বলে দুদক সচিবের কাছে অভিযোগ করেন জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক এনামুজ্জামান চৌধুরী।
দুদক সচিবের নির্দেশে অভিযোগের বিষয়ে সিভিল সার্জন ডা. আশুতোষ দাশ জাবাব দিতে গিয়ে অভিযোগ অস্বীকার করে ডাক্তার ও যন্ত্রপাতি সংকটের প্রসঙ্গে কথা বলেন।
সাংবাদিক পংকজ কান্তি দে বলেন, মাননীয় পরিকল্পনামন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে হাওরের জলমহাল ইজারার বিপক্ষে বক্তব্য দিয়ে থাকেন। কারণ তিনি জানেন ইজারার নামে কিভাবে দুর্নীতি ও প্রকৃতি বিনাশ হয়। কে কোন জলমহাল কিভাবে ভোগ দখল করে তার কোন তথ্য নেই। তথ্য চেয়েও পাওয়া যায় না।
এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে দুদক সচিব জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদকে এ সংক্রান্ত তথ্য ওয়েবপোর্টালে আপলোড করার নির্দেশ দেন। জেলা প্রশাসক জানান, এসব তথ্য হালনাগাদ করে আপলোড করার প্রক্রিয়া চলছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মালেক হুসেন পীরও জলমহাল ইজারার নামে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আনেন। তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করেও তথ্য পাওয়া যায়না বলে অভিযোগ করেন তিনি।
সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের নির্মাণকাজের প্রসঙ্গ সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত নিজেই উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন পরে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি বাস্তবায়িত হয়েছে। এ নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা হয়েছে। কাজে বিলম্বও হচ্ছে। কাজ ঠিকমতো হচ্ছে কি না তা দেখতে হবে। দুদক ওয়ার্ক অর্ডার দেখে কাজ মনিটরিং করবে। দুদকের সিলেটের পরিচালককে তিনি এ বিষয়ে মনিটরিং করে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি।
এদিকে শুরুতেই দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত স্বাগত বক্তব্যে দুদকের অভিযোগ সম্পর্কে তথ্য উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, গত দুই বছরে দুদকের কল সেন্টারের ১০৬ নম্বরে ৩১ লাখ অভিযোগ পড়েছে। এ ছাড়াও নানা প্রক্রিয়ায় মানুষজন দুদকে অভিযোগ করেন। এসব অভিযোগ দুদক তিনটি পর্যায়ে যাচাই-বাছাই করে। এরপর তফসিলভুক্ত অভিযোগগুলোর তদন্ত করে। তিনি বলেন, সরকারি কর্মকর্তারা ঘুষ চাইলে হাতেনাতে ধরিয়ে দিতে হবে। এ জন্য দুদক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফাঁদ পাততে হবে। দুর্নীতির বিস্তার রোধ করতে না পারলে উন্নয়নকাজে সফলতা আসবে না। তিনি বলেন, সরকারি কাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। দুদক সুনির্দিষ্ট বিষয়ে দুর্নীতির তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু এ বিষয়ে জনগণের মাঝে সঠিক ধারণা না থাকায় ব্যক্তিগত বিষয় নিয়েও অনেকে অভিযোগ করেন, যে কারণে আমাদের করার কিছু থাকে না।
দিলোয়ার বখত আরো বলেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাতেনাতে ঘুষগ্রহণ, তাদের নিজেদের ও পরিবারের সদস্যদের নামে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, অনুমতি না নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করা, অপরাধীকে রক্ষার চেষ্টা করা, জালিয়াতি ইত্যাদি বিষয়ে সংঘটিত দুর্নীতি প্রতিরোধে দুদক কাজ করে থাকে। তিনি বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান এখন জিরো টলারেন্স। কেউ অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন করলেও এখন আর সেটা ভোগ করতে পারবে না। দুর্নীতি সংঘটনের জন্য আমাদের অপেক্ষা না করে দুর্নীতি সংঘটিত হওয়ার পূর্বে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত আরো বলেন, সরকার প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তথ্যের দুয়ার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বিবেকের দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করতে হবে। সরকারি সংস্থা ও কর্মকর্তাদের কেবল স্বচ্ছ থাকলে চলবে না, নিজেদের স্বচ্ছতার বিষয়টি প্রকাশও করতে হবে।