শামস শামীম ::
১৯৭১ সনে মহান মুক্তিযুদ্ধে হাওরঘেরা জনপদ শাল্লা গণহত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের কারণে বিরান এলাকায় পরিণত হয়েছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত জনপদের দুর্গম এই এলাকা পুনর্গঠন সহায়তার লক্ষ্যে ১৯৭২ সনের একদিন ছুটে এসেছিলেন ফজলে হাসান আবেদ। জন্ম দিয়েছিলেন ব্র্যাকের। এই সময়ই তিনি তাঁর বন্ধু আমিনুল ও আশরাফুলকে সঙ্গে নিয়ে কার্যক্রম শুরু করেছিলেন ঘুঙ্গিয়ারগাঁওয়ে। ওই সময় সকল কর্মী ও এলাকার সংগঠক ও সদস্যদের তাঁকে ‘স্যার’ নয় ‘ভাই’ বলার নিয়ম করেছিলেন তিনি। শুক্রবার (২০ ডিসেম্বর) রাতে ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের মৃত্যুর খবরে শাল্লা উপজেলায় ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাকালীন সংশ্লিষ্টরা নানা স্মৃতি রোমন্থন করে অশ্রুসজল শ্রদ্ধায় স্মরণ করেছেন তাঁকে। তারা ব্র্যাকের জন্ম এলাকায় স্যার ফজলে হাসান আবেদ-এর স্মৃতি ধরে রাখতে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তাঁকে ‘হাওরে নারী জাগরণের অগ্রদূত’ বলে মন্তব্য করেছেন।
শাল্লা এলাকার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, মুক্তিযোদ্ধা, প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ও কৃষক আন্দোলনের নেতাদের সহযোগিতায় ১৯৭২ সনে ঘুঙ্গিয়ারগাঁও থেকে ব্র্যাকের কার্যক্রম শুরু করেছিলেন বাংলাদেশের পালাবদলের নায়ক ফজলে হাসান আবেদ। তাঁর মৃত্যুর খবর ব্র্যাকের জন্ম এলাকা হাওর-ভাটির জনপদে পৌঁছলে সেই সময়ের কর্মী ও সংগঠকরা দুঃখ ভারাক্রান্ত হন।
ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাকালীন সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৯৭২ সনে হাওরের দুর্গম জনপদ শাল্লায় ছুটে আসেন ফজলে হাসান আবেদ। যুদ্ধের চিহ্ন তখন পথে-প্রান্তরে। পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসররা ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ায় শরণার্থী শিবির থেকে ফিরে বিপাকে পড়েন সাধারণ মানুষ। এক অমানবিক ও অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মুখে পড়েন তারা। এই সময়ে ফজলে হাসান আবেদ ছুটে এসে তাদেরকে সান্ত্বনার বাণী শোনান। বিধ্বস্ত জনপদ পুনর্গঠনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কমরেড বরুণ রায়, শাল্লা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শ্রীকান্ত দাস, কৃষক সমিতির নেতা রমানন্দ দাস, ক্ষেত মজুর আন্দোলনের নেতা কমরেড অমর চাঁন দাস, পল্লী চিকিৎসক মনোরঞ্জন দাস, ঋষিকেশ চক্রবর্তীসহ হাওর এলাকার রাজনীতি ও সমাজসচেতন ব্যক্তিদের পরামর্শ নিয়ে ঘুঙ্গিয়ারগাঁও থেকেই ব্র্যাকের কার্যক্রম শুরু করেন। ওই সময় একদিন কমরেড বরুণ রায়ের সঙ্গে দিরাই এসে দেখা করে হাওর এলাকার বরুণ রায়ের নেতাকর্মীদের সহযোগিতার জন্য অনুরোধ জানান।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, শাল্লা এলাকা হিন্দু অধ্যুষিত থাকায় মুক্তিযুদ্ধের সময় আক্রান্ত হয় বেশি। সবার বাড়িঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। যুদ্ধের পরে এলাকার মানুষ শরণার্থী ক্যাম্প থেকে ফিরে নিজেদের বাড়িঘরই চিনতে পারছিলেন না। তাই তাদের অনেকেই উদ্বাস্তু হয়ে জীবনযাপন করছিলেন। বেশিরভাগ মানুষই স্কুলঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ঘুঙ্গিয়ারগাঁও বাজারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কোন দোকানপাট, থাকা ও খাওয়ার সুযোগ ছিলনা বাইরের মানুষের জন্য। এমন এক সময়ই দেশ পুনর্গঠনের স্বপ্ন নিয়ে এখানে আসেন ফজলে হাসান আবেদ। তাকে সরকারি ডাকবাংলোয় রাখেন স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। খাবার হোটেলের ব্যবস্থা না থাকায় কৃষ্ণকমল নামের এক ব্যক্তির বাড়িতে রান্নাবান্নার যোগান দিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ওইদিনই ফজলে হাসান আবেদ কমিউনিস্ট পার্টি নেতা রমানন্দ দাসকে অনুরোধ করেন ২০-২৫ জন স্বেচ্ছাসেবী যোগাড় করে দেওয়ার জন্য। রমানন্দ দাস রাতেই ২০-২৫ জন লোককে নিয়ে ডাক বাংলোয় চলে আসেন। তখন ফজলে হাসান আবেদ তার আসার কারণ বর্ণনা করে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন। তাঁর মুখে দেশ পুনর্গঠনের বক্তব্য ও সাধারণ মানুষদের অধিকারসচেতন করার কথায় আশ্বস্ত হন উপস্থিত লোকজন। পরদিন তাদের মধ্যে ফরম বিতরণ করে এলাকার কেস স্টাডি করার কথা বলে কাজ বুঝিয়ে দেন। তিনি নিজেও এলাকায় এলাকায় গিয়ে এক সপ্তাহ কাজ করেন। প্রত্যেক স্বেচ্ছাসেবীকে এক সপ্তাহের জন্য ৩৫ টাকা করে দিয়ে কাজ বুঝিয়ে চলে যান। এভাবেই শাল্লায় তাঁর আসা-যাওয়া শুরু হয়। স্বেচ্ছাসেবীদের রিপোর্টের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ১০টি ছোট পরিবার ও ১৪টি মাঝারি পরিবারকে বসতঘরের জন্য বাঁশ, টিন, দরোজা-জানালার ব্যবস্থা করে দিয়েই মূলত ব্র্যাকের ‘শাল্লা প্রজেক্ট’ শুরু করেন তিনি। কিছুদিন পরেই ‘গণকেন্দ্র’ নামে প্রতিষ্ঠান করে নারীদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের উদ্যোগ নেন। বের করেন ‘গণকেন্দ্র’ নামের একটি অনিয়মিত পত্রিকা। এর নামকরণ করে দেন কমরেড শ্রীকান্ত দাস। ব্র্যাকের জন্মের পর নারী ও কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যা, স্বাস্থ্য সমস্যাসহ গ্রামে গ্রামে গিয়ে সচেতনতামূলক পরিচালনা করতেন ব্র্যাকের কর্মী ও শুভানুধ্যায়ীরা। এতে হাওর এলাকার নারীদের মধ্যে সাড়া পড়ে। তারা সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত হন। এভাবেই হাওর জনপদ শাল্লার ঘুঙ্গিয়ারগাঁও থেকেই ব্র্যাকের ‘শাল্লা প্রজেক্ট’ অগ্রযাত্রা শুরু হয়। তবে পদে পদে ধর্মান্ধগোষ্ঠী নারী জাগরণের ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে অপপ্রচারে লিপ্ত হলেও অগ্রযাত্রা থামাতে পারেনি বলে প্রতিষ্ঠাকালীন সংশ্লিষ্টরা জানান।
ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাকালীন সংগঠক ও সহায়তাকারী রমানন্দ দাস বলেন, মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭২ সনে দেশে ফিরে দেখি আমার বাড়িঘরসহ এলাকার সকলের বাড়িঘরই ক্ষতিগ্রস্ত। এর মধ্যেই একদিন আমাকে ঘুঙ্গিয়ারগাঁও ডেকে নেন ফজলে হাসান আবেদ। ডাকবাংলো থেকেই শুরু হয় ব্র্যাকের কার্যক্রম। তিনি যে স্বপ্ন নিয়ে সংগঠনের জন্ম দিয়েছিলেন সেটি এখন কেবল জাতীয় পর্যায়েই নয় আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সুনাম বয়ে এনেছে। তাঁর মতো কর্মবীর ও সৎ মানুষ জীবনে কম দেখেছি। আমাদের হাওরের নারী জাগরণের অগ্রদূত ছিলেন তিনি। আরাম-আয়েশের জীবন পেছনে ফেলে ছুটে এসেছিলেন মানুষের কল্যাণে। এখন তো তিনি বিশ্ব পরিবর্তনের অন্যতম নায়ক। তাঁর মৃত্যু নেই।
কমরেড অমর চাঁন দাস বলেন, দেশ পুনর্গঠনে আমাদের এলাকায় এসে কাজ শুরু করেন তিনি। আমরা তাঁকে সহযোগিতা করি। একসময় কাজ দেখে মনে হয়েছে এলাকার উন্নয়নের লক্ষ্যেই তাঁর কর্মী হওয়া উচিত। আমি ব্র্যাকের হয়ে কয়েক বছর কাজ করি। আমরা তাঁর নেতৃত্বে গ্রামে ঘুরে নারীদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচারণা করতাম। মানুষ এতে ব্যাপক সাড়া দেয়। বিশেষ করে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে পুনর্গঠনের লক্ষ্যে ঘরবাড়ি নির্মাণ করে মানুষের বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়ে মানুুষের বিরাট উপকার করেছিলেন ফজলে হাসান আবেদ। এমন মানুষের সঙ্গে ও তাঁর স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শুরুতেই যুক্ত থাকতে পেরে আমি আনন্দিত। কাজের মাধ্যমেই বেঁচে থাকবেন এই মহান মানুষটি। তবে ব্র্যাকের জন্ম এলাকা হিসেবে শাল্লায় তাঁর স্মৃতিরক্ষায় বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।