৪ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আসবেন কোলকাতায়। এর আগে আরো কয়েকবার এসেছেন। তবে এবারের আগমনে আগ্রহ এবং উত্তেজনা বেশী। প্রচার-প্রচারণা চলছে জোরে শোরে। শরণার্থী বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, শিবিরে-শিবিরে একই প্রত্যাশা- এবার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে ভারত। আর এ ঘোষণাটি আসবে কোলকাতার জনসভা থেকেই। প্রধানমন্ত্রীর সফর একদিন এগিয়ে আনায় কৌতুহল আরো বেড়ে গেলো। দু’দিন আগে কংগ্রেস কর্মীদের সভায় ইন্দিরার সুর খুব চড়া ছিলো- দিন বদলেছে। তিন চার হাজার মাইল দূর থেকে বর্ণের প্রাধান্য নিয়ে ইচ্ছে মত হুকুমনামা জারি করবেন, তা আর মেনে নেয়া যায় না। ভারত আর নেটিভ রাজ্য নয়। আজ আমরা জাতীয় স্বার্থের জন্য দেশের সর্বোচ্চ প্রয়োজন অনুযায়ী কাজ করবো। ওই সকল বৃহৎ শক্তির ইচ্ছা অনুযায়ী নয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ববাংলা ছেড়ে গেলেই এক কোটি বাঙ্গালি দেশে ফিরে জীবন শুরু করতে পারবে।
কোলকাতা ও আশপাশের এলাকা থেকে দলীয় কর্মী সমর্থকরা ট্রেন বোঝাই, ট্রাক বোঝাই হয়ে আসছে। অকংগ্রেসীরাও সভায় এসেছে। বামপন্থীদের কালো পতাকা প্রদর্শনের কোন কর্মসূচি নেই। এসেছে আশেপাশের শরণার্থী শিবির থেকে জয়বাংলার লোকেরাও। কোলকাতায় অবস্থানরত আমার মত আরো কত শরণার্থী আগেভাগে সভায় এসে উপস্থিত।
বিকেলে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের বিশাল জনসভায় ইন্দিরা গান্ধী ভাষণ শুরু করলেন। কখন ইন্দিরা স্বীকৃতির কথাটি উচ্চারণ করবেন, রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষা। জনসমুদ্রে নীরবতার ঢেউ। কিন্তু ইন্দিরা তাঁর ভাষণ শেষ করলেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতির কোনো ঘোষণা না দিয়েই। যুদ্ধের কোনো হুংকারও নেই। নুতন কোনো চমকও নেই। তিনি দেশের মানুষকে আরো বেশী ত্যাগ স্বীকার করার জন্য প্রস্তুত থাকতে আহ্বান জানালেন।
বক্তৃতা শেষ করে তিনি চলে গেলেন রাজভবনে। বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, শিল্পী-সাহিত্যিকদের সাথে ঘরোয়া সভা। আলাপ আলোচনার মাঝেই ফোর্ট উইলিয়াম থেকে সামরিক উর্দি পরিহিত একজন পদস্থ কর্মকর্তা এসে উপস্থিত। একটি চিরকুট পৌঁছে দিলেন প্রধানমন্ত্রীর হাতে। চোখ বুলিয়ে চিরকুটের বিষয়বস্তু সম্পর্কে কিছু না বলে আলোচনা অসমাপ্ত রেখে উঠে পড়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন তিনি। লিফটের অপেক্ষা না করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে প্রায় দৌড়েই জিপে উঠে ছুটলেন বিমানবন্দরের দিকে। সঙ্গে সিদ্ধার্থ শংকর রায়। বিমানে বসেই নির্দেশ পাঠালেন পি.এন. হাসকারের কাছে- রাতে মন্ত্রীপরিষদ কাউন্সিল, কেবিনেট মিটিং, বিরোধীদলীয় নেতাদের সাথে বৈঠকের ব্যবস্থা করতে। কয়েকটি ফাইটার বিমান প্রধানমন্ত্রীর বিমানটিকে পাহারা দিয়ে নিরাপদ এলাকা পর্যন্ত পৌঁছে দিল। দিল্লীর উপর থেকে রাজধানী শহরটিকে নিষ্প্রদীপ দেখলেন প্রধানমন্ত্রী।
কোলকাতায় খবর রটে গেলো- পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করেছে। পশ্চিমাঞ্চলের পাঁচটি জায়গায় এবং আগরতলায় বোমা ফেলেছে। যুদ্ধের খবরে মানুষের উদ্বিগ্ন হবারই কথা। কিন্তু এবার এমন কোনো লক্ষণ দেখা গেলো না। যুদ্ধের জন্যই যেন অপেক্ষা করে আছে মানুষ। ওইদিনই ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরার অধিনায়কত্বে গঠিত হয় ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ড। ভারতীয় বাহিনী হলো মিত্রবাহিনী। রাতে ভারতের রাষ্ট্রপতি সারাদেশে জরুরি অবস্থা জারি করলেন। সকল বৈঠক সম্পন্ন করে, সেনা কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা শেষে মধ্যরাতের পরে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বেতার ভাষণের মাধ্যমে জানালেনÑ ভারতও যুদ্ধঘোষণা করেছে।
রাত সাড়ে এগারোটায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীই প্রথম অভিযান চালিয়ে নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের দু’টি ফুয়েল পা¤প ধ্বংস করে দেয়। গভীর রাতে কোলকাতার আকাশ কাঁপিয়ে দিয়ে কয়েকটি বিমান উড়ে গেলো ঢাকায় বোমা ফেলতে। তেজগাঁ বিমান বন্দর কয়েকবার আক্রমণের ফলেই অকেজো হয়ে রইলো। পরের দু’দিনের বিমান হামলায় কুর্মীটুলার নবনির্মিত রানওয়েসহ কোন বিমান বন্দরই অক্ষত রইলো না। পাকিস্তানি যুদ্ধবিমানগুলি মাটিতে পড়ে থেকেই কেবল মার খেলো।
মুক্তিযুদ্ধের গতি প্রকৃতি নুতন মোড় নিলো।
[শরণার্থী৭১ – সুখেন্দু সেন]