মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির পক্ষ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে এবং সেই সঙ্গে রাজাকারদের তালিকা চূড়ান্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের ঋণ দেওয়া আর রাজাকারদের তালিকা তৈরি করা এই দু’টি কাজের সুপারিশ করা হয়েছে, সে-জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু করণীয় বিষয়টি বড়বেশি দেরিতে হয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই, এর অবশ্য ঐতিহাসিক কারণও আছে। এই কারণটি দেশের পরিস্থিতিকে বদলে দিয়েছে খোল নলচে সমেত। মুক্তিযোদ্ধা কাঁকনবিবিকে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করতে হয়েছে কিংবা একজন মুক্তিযোদ্ধাকে রিকসাওয়ালা হয়ে জীবনের ঘানি টানতে হয়েছে বুড়ো বয়সে। অপরদিকে রাজাকার কিংবা রাজাকারের উত্তরসূরি হয়েছে জনপ্রতিনিধি চেয়ারম্যান, মেম্বার থেকে সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি অথবা যুদ্ধকালে লুট করা ধনের বদৌলতে বড় ধনকুবের। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে মুক্তিযোদ্ধাদের হটিয়ে রাজাকাররা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। ঘটনা এমন পর্যায়ে গেছে যে, মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাধীন করা এই দেশে জনসভার মঞ্চ থেকে মুক্তিযোদ্ধাকে লাথি মেরে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে যে-সব জেলা ও উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স তালাবদ্ধ অবস্থায় আছে সেগুলো খোলে দেওয়ার সুপারিশ করতে হচ্ছে।
আফসোস করার আপাতত কোনও অবসর নেই। দেরিতে হলেও রাজাকারদের চিহ্নিত করা একটি জরুরি কাজ। অন্তত বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে, উত্তরসূরিদের মঙ্গলের কথা ভেবে রাজাকারদের ও রাজাকারদের উত্তরসূরিদের চিহ্নিত করে যাওয়ার কাজটি একটি মহৎ কাজ। মানবতা, স্বার্থে, সামাজিক ন্যায়বিচার, মানুষের মুক্তি ও ঐতিহাসিক সত্য প্রকাশের স্বার্থে এই কাজটি (রাজাকারের তালিকা প্রণয়ন) একটি মহৎ কাজ কেবল নয়, জাতির জন্য এই কাজটি একটি অবশ্য করণীয় কাজ। এই কাজটি করা না হলে উত্তর প্রজন্মের কাছে দায়বদ্ধ হয়ে থাকতে হবে বর্তমান প্রজন্মকে। এই দায় আদায় করে যাওয়া একটি জাতীয় কর্তব্য তো বটেই, সেই সঙ্গে নিজেকে প্রতিপন্ন করার কর্তব্য বলেও বিবেচিত। নিজেকে প্রতিপন্ন করা এই অর্থে যে : আমি রাজাকার নই, আমি জাতীয় বিশ্বাসঘাতক নই এবং নিজেকে আমি পরদেশি, পরজাতির কাছে বিক্রি করে দেইনি। ভুলে গেলে চলবে না, মুক্তিযুদ্ধের পর বাঙালির একটাই নিয়তি : বাঙালিকে বাঙালি হয়েই বাঁচতে হবে রাজাকার হয়ে নয়। বাংলাদেশের উত্তরপ্রজন্ম রাজাকারকে ঘৃণা করবে, এটাই ঐতিহাসিক নিয়তি।