শামস শামীম ::
সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরে এখন লাল শাপলা ঝিলিক দিচ্ছে। মৃদুমন্দ হাওয়ায় দিচ্ছে দোলা। অবহেলায় ফুটে থাকা শাপলা দীর্ঘদিন ধরে হাওরবাসীকে মুগ্ধতায় আবিষ্ট করে রেখেছে। কোনটির সৌন্দর্য্য স্থানীয় সীমানা ছাড়ালেও কোনটি এখনো স্থানীয়ভাবেই মানুষকে মুগ্ধ করেছে। হাওরবাসী শুধু মুগ্ধতায়ই মাতছেন না খাদ্যাভ্যাসেও শাপলা ডাটাকে স্থান দিয়েছেন। সাদা শালুকতো রসনায় অন্যরকম তৃপ্তি দেয়। দুর্গাপূজা ও লক্ষ্মীপূজায় হাওরের সনাতন ধর্মের লোকজন পদ্মজ্ঞানেই লাল শাপলা ফুলে দেবীকে অর্ঘ্য দেন।
সুনামগঞ্জে প্রায় দেড় শতাধিক হাওর রয়েছে। বেশ কিছু হাওরের বদ্ধ জলাভূমি শ্রেণির জমিতেই লাল শাপলার সমাহার লক্ষ্য করা যায়। টাঙ্গুয়ায় লাল নীল ও শাদা শাপলার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে দেড় যুগ আগেই। রেডবুক ডাটা জরিপে এই তথ্য জানিয়েছে আইইউসিএন। অন্যান্য হাওরেও নানা প্রজাতির শাপলা থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন উদ্ভিদ ও প্রাণবৈচিত্র্য গবেষকরা। কোন কোন হাওরের জলাশয়ে লাল শাপলার বিস্তৃতি মুগ্ধতার সীমা ছাড়িয়েছে। সেই সৌন্দর্য্যে অবগাহন করতে পর্যটকরাও দিচ্ছেন ছুট। সম্প্রতি এমনই এক কাশতাল বিকিবিলকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রথম বারের মতো তুলে ধরেছেন তাহিরপুরের সাংবাদিক বাবরুল হাসান বাবলু। নেট দুনিয়ায় তার তোলা ছবি এখন ঘুরপাক খাচ্ছে নানাজনের দেয়ালে। মূলধারার মিডিয়াও এই লাল শাপলার বিকিবিল হিসেবে উপস্থাপন করছে। জেলা প্রশাসন অন্যতম পর্যটন স্পট হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে এই বিলকে। সেখানে সৌন্দর্য্য পিয়াসীরা ভিড় করছেন।
গত মঙ্গলবার আবৃত্তিকার ও সাংবাদিক শিল্পী মহলানবিশ যাচ্ছিলেন তাহিরপুর। সকাল ১০টায় বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার পদ্মনগর গ্রামের পাশের বারো মুনির বিলে গিয়ে লাল শাপলার বিস্তার দেখে মুগ্ধতা প্রকাশ করেন তিনি। ওই সময় শাপলার সমাহারের মধ্যে ফাঁকে ফাঁকে মাছ ধরছে কিছু লোক। খোলসভাঙ্গা লাল ফুটে আছে থরে থরে। সবুজ পাতায় যেন লাল পোষাকের মুনিই ফুটে আছেন। বারো মুনি যেন সাধনায় নত। সাতসকালে এক অদ্ভুত আবহ বিরাজ করে পদ্মনগরে। স্থানীয় প্রকৃতিঘনিষ্ঠ মানুষজন দীর্ঘদিন ধরে পদ্মনগরের পদ্মরূপী লাল শাপলার সৌন্দর্য্য উপভোগ করছেন।
দিরাই উপজেলার চরনারচর এলাকার পদ্মবিলকে ২০১৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘পদ্মবিল’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে বেঞ্চ। ওই সময় বিপুল দর্শক ঘুরে আসেন পদ্মবিল। নেট দুনিয়ায় তখন এ নিয়ে মাতামাতিও হয়।
এমন লাল শাপলার সমাহার দেখতে পাওয়া যায় বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার খোদাদিলা বিলে। নিয়ামতপুরের ঝালোরধলা বিলেও লাল শাপলার বিস্তার দেখা যায়। সাচনা-সুনামগঞ্জ সড়কের পাশে হওয়ায় অনেক পথচারী এখানেও আনন্দ খুঁজেন। তাহিরপুরের টাঙ্গুয়ার হাওরঘেঁষা উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের কয়েকটি স্থানেও লাল শাপলার ঢেউ দেখা যায়। টাঙ্গুয়ার পর্যটকরা এখানেও ঢু মেরে মন মজান। এভাবে জেলার বিভিন্ন হাওরের বদ্ধ জলাশয়ে লাল শাপলার বিপুল বিস্তার লক্ষ্য করা যায়।
সেপ্টেম্বর থেকেই মূলত ফুটে লাল শাপলা ফুটতে থাকে। পানির বিস্তার থাকা পর্যন্ত লালে লাল ঢেয়ে রঙিন রাখে চারপাশ। পানি সরে গেলে হারিয়ে যায়। আবার বর্ষা শেষে শরতে খোলস ভেঙে ফুটতে থাকে দলে দলে। ডুবো ডুবো খেলায় মাতিয়ে রাখে পানি থাকা পর্যন্ত।
সাংবাদিক ও পর্যটক বাবরুল হাসান বাবলু বলেন, শুধু বিকিবিলই নয় সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরের বদ্ধ জলাশয়েই এই সময়ে যুগযুগ ধরে স্থানীয় মানুষজন লাল শাপলার সৌন্দর্য্যে অবগাহন করছেন। এখন কোন কোন জলাশয়ে পর্যটকদের দৃষ্টি পড়েছে। তারা লাল শাপলার সৌন্দর্য্যে মাতছেন। তবে হাওরবাসীর কাছে এই সৌন্দর্য্য নতুন নয়।
হাওরের উদ্ভিদবৈচিত্র গবেষক কল্লোল তালুকদার চপল বলেন, হাওরে লাল শাপলার বিস্তার আগেও ছিল। সব হাওরেই কমবেশি এই সময়ে শাপলার রাজত্ব দেখা যায়। তবে এগুলোকে পদ্মপ্রজাতি বলা যাবে না। এগুলো শাপলা প্রজাতিরই এবং দেশজ। তিনি বলেন, লাল শাপলা মিঠাপানির জলজ উদ্ভিদ। এর বৈজ্ঞানিক নাম নিমফিয়া রুব্রা। রাতে ফোটে সকালে রোদের তাপে গুটিয়ে নেয় নিজেকে।