শিশু তুহিন হত্যা। নির্মম নৃশংস নির্দয় নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত রূপ। মানবতা সমাজ সভ্যতার স্কন্ধে তুলে দেওয়া হয়েছে পাশবিক পীড়নের বিস্ময় বিমূঢ় বোঝা। একজন পিতা তার ঔরসজাত সন্তানকে গলা কেটে হত্যা করতে পারে, এটা শুধু চরম পৈশাচিকতাই নয়, মধ্যযুগীয় বর্বরতা আর পশুত্বকে হার মানিয়ে স্তব্ধ করে দিয়েছে মানবিক বলয়ের চলন্ত গতি। বাকরুদ্ধ করেছে তুহিনের এলাকা আশপাশের মানুষকে। তুহিন শোকে মুহ্যমান সকলে। নিষ্পাপ শিশু তুহিনকে যারা যেভাবে হত্যা করেছে তাদের তুলনা ইতর শ্রেণিভুক্ত কোন প্রাণীর সাথে করলে সে প্রাণীকেও যে ছোট করা হবে। কারণ কোন পশুও তার সমগোত্রীয় পশুকে হত্যা করে না। যা করে দেখিয়েছে তুহিনের বিবেকবর্জিত বর্বর বাবা, চাচা ও চাচাতো ভাই।
অবিশ্বাস্য অধম অপকর্মধারী মানুষ নামীয় ঐ নরপশুগুলো পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট, নির্দয়, মানবতার শত্রু। প্রতিবেশী বিরোধী বলয়কে বিপদে ফেলতে মনুষ্য রক্তে-মাংসে গড়া পিতা কিভাবে আপন পুত্রকে হত্যা করল তা ভেবে অনেকে বোধভ্রষ্ট হয়ে পড়ছেন। দিরাইয়ের এই লোমহর্ষক ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, শিশুর জন্য তার জন্মভিটেও আজ নিরাপদ নয়। যাদের কোলে জন্ম নিয়ে শিশু কেঁদেছিল পৃথিবী বরণের হর্ষিত কান্না সেই নিরাপদ নিঃসংশয় পৃথিবীটাই তার জন্য সম্পূর্ণভাবে অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। শিশুর জন্য নিরাপদ পৃথিবী তৈরি করতে পারিনি আমরা। আজ বড়দের জিঘাংসার বলি হচ্ছে নিষ্পাপ শিশু। অত্যন্ত নির্মমভাবে শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে। ধর্ষণের পর মেরে ফেলা হচ্ছে শিশুদের।
সর্বশেষ দিরাই উপজেলার কেজাউড়া গ্রামে পিতা কর্তৃক শিশু তুহিন হত্যার ঘটনাটি সারাদেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। খবরে জানা যায়, ১৩ অক্টোবর রাত আড়াইটার দিকে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে বাবা আবদুল বাছির তুহিনকে কোলে করে ঘরের বাইরে নিয়ে যায়। পরে তার কোলেই চাচা নাছির উদ্দিন ও চাচাত ভাই শাহরিয়ার তুহিনকে খুন করে। পরে তুহিনের কান ও লিঙ্গ কেটে পেটে ছুরি ঢুকিয়ে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখে এই পাষণ্ডরা। যে খবরে শিউরে উঠে দেশ। শিশুর নিরাপদ পরিবেশ নিয়ে উঠে প্রশ্ন।
আপন পৃথিবীটা দানব দস্যু রূপ ধারণ করবে, কোন সন্তান কি তা অনুধাবন করতে পারে? তাও যদি হয় তুহিনের মতো পাঁচ বছরের অবোধ অশান্ত শুচিশান্ত শিশু তাহলে তার জন্য এই পিতৃ পশুত্বপনার মরণ মারাত্বক বাস্তবতা বোঝা যে একেবারে অসাধ্য। প্রতিদিনের ন্যায় আপন আলয় প্রিয় পিতার শিয়রে শির পেতে ঘুমিয়ে পড়েছিল তুহিন। নির্দয় নিষ্ঠুর পিতা গভীর ঘুমে অচেতন পুত্রের প্রাণ সংহারি নির্মম নৃশংস নেশায় রাত গভীরতার ক্ষণ গুণছিল তা নির্জন নিশি ও শান্ত প্রকৃতির কেউই টের পায়নি। কিংবা ভয়ের তাড়নায় সন্ত্রস্ত শিশুর মতো মৃত্যুরকম কোন দুঃস্বপ্নও তাড়া করেনি ঘুমকাতর নিরপরাধ শিশু তুহিনকে।
ঘুমন্ত রাতটা হত্যা উপযোগী সময়ে হাজির হলে বদ বর্বর পাষ- পিতা নিজের ঔরসজাত শিশু সন্তানকে টেনেহেচড়ে তুলে নিয়ে যায় বাহিরের নীরব নিষিদ্ধ স্থানে অপেক্ষা করা অন্য হন্তারক হায়েনাদের কাছে। ঘুমের ঘোরে শিশু তুহিন চোখ মেলে তাকিয়ে হয়তো পিতার কাঁধে মাথা পেতে ফের ঘুমের দেশ নিশ্চিন্তপুরে চলে যায়। কিন্তু রাক্ষসরূপী পিশাচ পিতা ঘুমভোলা শিশুপুত্রকে কোলে রেখেই সঙ্গীয় মনুষ্য জন্তু জানোয়ারদের নিয়ে তুহিনের গলায় চালায় ছুরি ধারলো ধাতব অস্ত্র। তখন মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে পাঁচ বছর বয়সী নিরীহ নিরপরাধ তুহিন। মৃত্যু নিশ্চিত করে পিতা পাষণ্ডের দল তুহিনের লিঙ্গ ও কান কেটে তার পেটে ছুরি ঢুকিয়ে গাছে ঝুলিয়ে চলে যায় যে যার ঘরে। শেষরাতে এসে তুহিনের বীভৎসবাদী বাবা ঘুম থেকে জেগে ছেলেহারা মায়াকান্নার ভান করতে থাকে। এদিকে খুনী পিতার ঢঙ-তামাশা অন্যদিকে রাতের আঁধারে ঝুলতে থাকা তুহিনের নিথর দেহ বর্বরতার নজির সৃষ্টি করে স্তব্ধ করে দেয় প্রকৃতি চারপাশ।
দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যা। শিশুদের ওপর সহিংসতা দিনদিন বেড়েই চলেছে। শিশু তুহিন হত্যার পরদিন লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় প্রথম শ্রেণির ছাত্র শিশু কাউছারকে হত্যা করে তার মা স্বপ্না বেগম। ১০ টাকা চাওয়ার অপরাধে সন্তানকে গলা টিপে হত্যা করে এই জন্মধাত্রী। গত পাঁচ বছরে দেশে এ রকম ১ হাজার ৬৩৪ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। এ বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে হত্যা করা হয়েছে ৩২০ শিশুকে। সর্বশেষ শিশু তুহিন হত্যায় শিউরে উঠে মানুষ। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য মতে, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৯ শিশুকে। অপহরণের পর হত্যার শিকার ২৩ শিশু। এ ছাড়া প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোসহ বিভিন্ন কারণে খোদ জন্মদাতা ও জন্মদাত্রীর হাতেই হত্যার শিকার হয়েছে ২৮ শিশু।
২০১৫ সালের ৮ জুলাই সিলেটের কুমারগাঁওয়ে চুরির অপবাদ দিয়ে খুঁটিতে বেঁধে ১৩ বছরের শেখ সামিউল আলম রাজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে হত্যাকারীরাই সেই নির্যাতনের ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়ে সারাদেশে চরম ক্ষোভ ও আলোচনার জন্ম দেয়। এর বিরুদ্ধে মানুষ প্রতিবাদী হয়ে উঠলে মাত্র ১৭ কার্যদিবসে বিচারিক কার্যক্রম শেষ করা হলেও আসামিপক্ষের আবেদনে মামলাটি এখনও উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগে রয়েছে। ২০১৬ সালের ৩১ মে বরগুনার তালতলীতে ১১ বছরের শিশু রবিউলকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। ওই মামলার পরের বছর ৩ আগস্ট জেলা আদালত আসামিদের ফাঁসির আদেশ দেন। একই সময়ে গাজীপুরের টঙ্গীতেও মোজাম্মেল হোসেন মাজু নামের ১৬ বছরের এক কিশোরকে শেকলে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করে পাষণ্ডরা। কিন্তু এসব ঘটনায় যে দু’একটির বিরুদ্ধে মানুষ ফুঁসে উঠেছিল সেগুলোর বিচার হয়েছে ঠিকই, তবে বিচারের শেষ পরিণতি দেখতে পারেনি মানুষ। আর অন্যসব ঘটনা বিচারহীনতার গণ্ডিতে আটকে পড়ে হারিয়ে ফেলেছে বিচার পাওয়ার বৈধতা। এ নিয়ে অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, পারিবারিক, জমিজমা কিংবা ব্যক্তিগত বিরোধের জেরে সারাদেশে এমন নির্যাতনের হার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। শত্রুকে পরাস্ত করতে টার্গেট করা হচ্ছে শিশুকে। মানসিক ব্যাধির কারণে ধর্ষণ, নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই পার পেয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা। ক্ষেত্রবিশেষে আইনের আওতায় আনা গেলেও অপরাধীরা যথোপযুক্ত শাস্তি পাচ্ছে, এমন নজির বিরল। [সূত্র : আমাদের সময়, ১৬.১০.১৯]
আমরা যেন বিচারহীন এক রাষ্ট্রে বসবাস করছি। যেখানে খুন করেও খুনিরা সহজেই পার পেয়ে যায়। আবার নির্দোষ নিরপরাধ জাহালমরা জেল খাটে। বিচারহীনতার এ সংস্কৃতি সমাজ সভ্যতাকে কলঙ্কিত করছে। একের পর এক জন্ম দিচ্ছে নির্মম-নৃশংস ঘটনা। শিশু তুহিন হত্যার বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেছেন, ‘শিশু হত্যাকাণ্ডের ঘটনা শুধু বর্বরতার পর্যায়ে নেই। বর্বরতার চেয়েও বর্বর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আগে হত্যা করতে মানুষ একবার চিন্তা করত। কিন্তু এখন অকারণে মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হচ্ছে। মূল্যবোধ বলতে অবশিষ্ট আর কিছু এ সমাজে নেই।’ বিশিষ্ট লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেছেন, ‘যে বা যারাই শিশুকে হত্যা করেছে তাদের মধ্যে পাশবিকতার উপাদান ষোলআনা। মনুষ্যত্বের লেশমাত্র নেই। এই মনুষ্যত্বহীন সমাজে বাস করছি। এই দায় অন্যের নয়, আমাদেরই বহন করতে হবে। কারণ আমরা দিনে দিনে সমাজকে এ পর্যায়ে নিয়ে গেছি। রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও আইনের শাসন, ন্যায়বিচার নেই। যদি থাকত তাহলে এই পৈশাচিকতা দেখতে হতো না।’ বিচারহীনতার কারণে দেশ দেখতে পাচ্ছে শিশু তুহিনের মতো অসংখ্য লাশ। অপরাধের সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করার মাধ্যমে এ প্রবণতা রুখে দেওয়া সম্ভব। [সূত্র : বা.প্র. ১৬/১০/১৯]
শিশুদের উদ্দেশ্যে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্য তার ‘ছাড়পত্র’ কবিতায় লিখেছিলেন- ‘এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান; / জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে। / চলে যেতে হবে আমাদের। / চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ / প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, / এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি / নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’ ক্ষণস্থায়ী পৃথিবী ছেড়ে সবাইকে একদিন বিদায় নিতে হবে, সজীব প্রাণে সকল বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে সদ্য ভূমিষ্ঠ নতুনের জন্য বসবাসের উপযোগী নির্মল ধরণী গড়ার দৃপ্ত শপথের কথা ব্যক্ত করেন কবি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে। কিন্তু শিশুকে দেওয়া কবির অঙ্গীকার কতটুকু রক্ষা করতে পারছে বর্তমান সমাজ সভ্যাতা। একটি শিশু জন্ম থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগ পর্যন্ত যতটুকু সামাজিক নিরাপত্তা পাওয়া দরকার তার সামান্যটুকুও কি পাচ্ছে তারা! চারপাশের নিত্য ঘটনা চিৎকার দিয়ে বলছে- না-না-না। দেশব্যাপী শিশু নির্যাতনের অমানবিক ঘটনাপ্রবাহ মানবতাবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে আগামী প্রজন্মের নিরাপদ পথচলা কঠিন হয়ে পড়বে।
[বিশ্বজিত রায়, সাংবাদিক ও কলামিস্ট, জামালগঞ্জ, সুনামগঞ্জ।]