মইনুদ্দিন আহমদ জালালকে একনামে সবাই চিনেন। তাঁকে এমনিতেই সবার থেকে আলাদা করা যেতো। তাঁর লম্বা চওড়া দেহসৌষ্ঠব, বাম গালে কালো আকর্ষণীয় ‘মাশা’, এককথায় সুদর্শন মানুষ। আমরা একসঙ্গে বেড়ে উঠেছি। শ্বেতকপোত খেলাঘর আসরের সদস্য হই সেই সময়। দাদু বিনোদ বিহারী নাগের বাসার সামনের মাঠে ফুটবল খেলি, সিগারেটের রাংচা দিয়ে শিল্ড তৈরি করে বা সুরমাদানি দিয়ে অন্য পাড়ার ছেলেদের সাথে ফুটবলে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে নামি, সে এক রঙিন সময় ছিল আমাদের।
সিলেটের বর্তমান দক্ষিণ সুরমার ধরাধরপুর গ্রামে তাদের আদি নিবাস। বিশাল ভূ-সম্পত্তিসহ সিলেট শহরে এখনও তাদের অনেক সম্পদ আছে। জালালের চার বোন। বড় আপা ফাতেমা বেগম মারা গেছেন। মেজো আপা নাজমা বেগম সুনামগঞ্জে থাকতেন। তারপর রহিমা আপা বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী। ছোট বোন মহিমা ইংল্যান্ড প্রবাসী। চার বোনের মধ্যে একমাত্র জালাল হচ্ছে তাঁদের আদরের ভাই। জালাল মা-বাবার একমাত্র পুত্র সন্তান হওয়ায় পরিবারের সকলের কাছে জালালের কদর ছিল সীমাহীন। জালাল আসলেই সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিল।
জালালের বাবা-চাচারা সুনামগঞ্জে থাকা ও খাওয়ার হোটেলটি চালু করেন অনেক বছর আগে। চেষ্টা করেও এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের শুরুর সন তারিখ বের করা সম্ভব হয়নি। প্রথমে হোটেলটি ছিল টিনসেডের। জালালের নামে নামকরণকৃত জালালাবাদ হোটেলটিতে শুরুর সময় কোন কাস্টমার দু’বেলা খাবার খেলে রাতে থাকার জন্য আলাদা করে ভাড়া দিতে হতো না। সুনামগঞ্জের কোর্ট-কাচারিতে আসা লোকজন বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে তৃপ্তি মতে থাকা খাওয়ার সুব্যবস্থায় জালালদের হোটেলের নাম ডাক ছিল। প্রথমদিকে জালালাবাদ হোটেলের মেইন গেইট ছিল টিনের দরজার। মূল হোটেল ও খাওয়ার ব্যবস্থা টিনসেড অংশে। পরে এর সাথে লাগোয়া পাকা নির্মাণাধীন বিল্ডিংয়ের একতলায় ছিল বেশ অনেকগুলো থাকার রুম।
যদি ছোটবেলার কথা বলি, জালালের বাবা-চাচাদের মধ্যে তাঁর বাবা হাজী সিকন্দর আলী ও চাচা ইউসুফ হারুন সাহেব স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সুনামগঞ্জে থাকতেন। মাটির প্রলেপ দেওয়া তাদের ঘরবাড়িতে তখনকার সময়ের আভিজাত্যের ছাপ ছিল। জালালের আপন চাচাতো ভাই আমিনুল ইসলাম টিপু ভাইয়ের ছোট আলাদা পড়ার রুম ছিল। অপর চাচাতো ভাই আইনুল ইসলাম বাবলু ভাইয়ের আলাদা পড়ার ঘর ছিল। বাবলু ভাইয়ের গোছানো পড়া ও থাকার রুমে খুব একটা আড্ডা জমত না। কেন না তাদের বসতঘরের নিকটবর্তী রুমটি হওয়ায় ঘরের সবার স্বাভাবিক নজরদারির মধ্যে বাবলু ভাইয়ের রুমে আড্ডা জমত না। আমাদের আড্ডাস্থল ছিল জালালের একত্রিশ নম্বর কক্ষ।
বর্তমান জালালাবাদ হোটেলের পিছনের অংশে একত্রিশ নম্বর কক্ষের অবস্থান। বাসার রাস্তা থেকে ভিন্ন রাস্তা দিয়ে একত্রিশ নম্বরে যেতে হত। যার জন্য এই অংশটি ছিল আমাদের জন্য মুক্ত এলাকা। একত্রিশ এর ছোট রুমে আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে জালাল সিলেট না যাওয়া পর্যন্ত আমাদের এই বিশাল ভুবনে পা পড়েছে অনেকের। জালাল ছিল একত্রিশ নম্বরের মধ্যমণি। সাধু-ঋষির মত তাপ, চাপ বুকে নিয়ে যেমন এখানে বসে থাকা যেত, তেমনি শহরের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রাম, কলেজ ইলেকশন, ছাত্র রাজনীতি, নাটক, গল্প, কবিতার শীতলতায় আমরা ‘যীশুর মত’ সেখানে নিমগ্ন থাকতাম। জালালদের বাসার পিছনের অমিয়েশ চক্রবর্তীর (অমিদার) বাসার ভিতর দিয়ে এসে জালালদের পাকঘরের টিনের দরজায় সামান্য ধাক্কা দিলেই খুলে যেত। আমাদের খাবারের কষ্ট হতো না। নাজমা আপারা ততোদিনে আমাদের এহেন অত্যাচার অনেকটাই মেনে নিয়েছেন। কিছু করার ছিল না। জালালসহ আমরা অনেকেই রাত জাগতে অভ্যস্ত ছিলাম। এরকম পরিস্থিতিতে আমরা রাতের পর রাত মাঝেমধ্যে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে নানান কথায় মেতে থাকতাম। কোন কোন সময়ে রাতের কুয়াশায় মাথা ভিজে গেলে মনে হতো, এ ঠাণ্ডার চেয়ে আমাদের সমবেত উত্তাপ কত না মধুর। রব্বানী ভাই (এডভোকেট রব্বানী) যে কোন বিষয়ে চিন্তায় পড়ে গেলে অপলক চোখে চেয়ে থাকত। চোখের পাতা না ফেলে দীর্ঘক্ষণ চেয়ে থাকার ক্রেডিট তার ছিল। শুনা যায় মোহাম্মদ সাদিক ও গোলাম রব্বানী শহরে আসতে ধারারগাঁও থেকে শহরের উত্তর প্রান্তে ষোলঘর শ্মশানঘাট পর্যন্ত যতগুলো ভাঙ্গা পড়ত (তখনকার কাচা রাস্তা আড়াআড়িভাবে ভেঙে পানির স্রোত বইত) সেই খালসমূহ পেরুতে তাঁদের কাপড় নাকি ভিজত না। তাঁরা পানিতে একটু নামতেন কাপড় একটু উঠত, আরো নামতেন কাপড় আরো উঠত। খালের পানি ও কাপড় তোলার এই সমীকরণে ¯্রােতের পানি কোন সময়ই তাদের পরিধেয় মূল্যবান কাপড়ের নাগাল পেত না। কাপড় না ভিজিয়ে তাদের খাল পাড় হওয়ার এই কৌশল ইতু ভাইয়ের ক্ষেত্রে প্রয়োগের সুযোগ ছিল না। ইজাজ আহমদ ইতু সুরমা নদীর উত্তরপাড় ইব্রাহিমপুর থেকে আসত। সাদিক ভাই, ইতু ভাই (বর্তমানে ইংল্যান্ড প্রবাসী), রব্বানী ভাই (প্রয়াত), দিলু চৌধুরী (প্রয়াত), ইকবাল কাগজী, বাবলু ভাই, মুশফিক হোসেন পীর ভাই (প্রয়াত), আনোয়ার ভাই, তৌফিক দোলন (ইংল্যান্ড প্রবাসী) সহ কেউ কেউ কাব্যচর্চা করতেন। শহরের তাবৎ ফুল, পাখি, নীল আকাশ, হাওরের ঢেউয়ের জন্য তাদের হাকাকার ছিল। মনপাখি ছুটে গেলেই কত না বিশ্লেষণ ব্যাখ্যা আফসোস চলত অবিরাম। মুশফিক ভাইয়ের কারো কবিতাই খুব একটা পছন্দ হত না। সাদিক ভাই, ইতু ভাইয়ের লিখা ‘সুজন সখী মার্কা’ কবিতা বলে তিনি নিমিষেই রিজেক্ট করে দিতেন। আমাদের পাড়ায় গোলাম রব্বানী নামে দু’জন ছিলেন। বড় রব্বানী ভাইকে আমরা আমাদের অভিভাবক হিসেবে সম্মান করতাম। পরে তিনি আমাদের নেত্রী শাহানা আপার (শামছুন নাহার বেগম) সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। বিপত্তি দেখা দেয় তখনই যখন আমাদের ছোট রব্বানী একই বাসায় আমাদের আরেক নেত্রী ফৌজিআরা বেগম শাম্মীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। জালাল, সুজাসহ আমরা এই দুই বিয়েতেই খুব মজা করি। এক বাড়িতে দুই গোলাম রব্বানী জামাই হওয়ায়, দু’জনকে আলাদা করতে, আমার ছোট রব্বানীর ‘র’-এর ফুটা তুলে দিয়ে তাঁকে ‘বব্বানী’ করে ফেলি। কেউ কেউ তাঁকে রাব্বি ডাকতেন।
জালাল, ওয়াহিদুর রহমান সুফিয়ান, আশীষ চৌধুরী (বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী), গোলাম জিলানী সুজা (বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী), মহিবুর রহমান (ইংল্যান্ড প্রবাসী), শান্তনু চৌধুরী (লম্বা বাসার শান্তুদা, প্রয়াত), আবুল হাসান লতিফ ভাই (বর্তমানে ইংল্যান্ড প্রবাসী), জেসমিন আপা, গায়ত্রী, শাম্মী, এড. রুহুল আমিন হিলু (বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী), বদরুল হুদা মুকুল, আমি সহ আমাদের সাংগঠনিক, সামাজিক ব্যস্ততার শেষ ছিল না। একত্রিশের রাজনৈতিক সভাগুলোতে শুধু সংশ্লিষ্টরা থাকতেন। একটি কথা না বললেই নয়, আমাদের অনেকেরই বয়সের পার্থক্য ছিল। কিন্তু একত্রিশে বসলে আমরা নিজ ব্যক্তিত্ব, বয়স, অবস্থা বুঝে চলতাম। আমাদের বয়স বৈষম্য কোন সময় আমাদের নির্মল আনন্দ আড্ডায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করেনি, শালীনতার মাত্রা ছাড়েনি।
আমাদের সময় প্রভাতফেরি, মহান স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, কলেজ ইলেকশন, ছাত্র ইউনিয়ন সম্মেলনসহ বড় প্রোগ্রামগুলোতে জালালাবাদ হোটেলে ক্যাম্প করা হতো। রাত্রি বেলা ছাত্ররা ও বিভিন্ন পাড়ার দায়িত্বপ্রাপ্তরা জালালাবাদ হোটেলে রাত্রিযাপন করতেন। জালালের হোটেলে ফ্রি থাকা ও খাবার ব্যবস্থার জন্য কারোই কোন চিন্তা নেই। অবলীলায় জালাল ম্যানেজ করত। রাতে আমরা রিকসা চালিয়ে কর্মীদের বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দিতাম। বিজন সেন, সন্তুদা, সিরাজ ভাই (মরহুম এড. সিরাজ), রেহান উদ্দিন আহমদ রাজু, ছাতকের কমরেড মানিক ভাই, কমরেড নজির হোসেন (সাবেক এম.পি.), দিরাইয়ের বনবীর রায় (বনদা), শাহানা আপা (সাবেক এম.পি. ও কলেজ ভিপি), নির্মলদাসহ একত্রিশ নম্বরে নিয়মিত-অনিয়মিত অনেকই আসতেন, অনেকের নাম মিস করেছি, এখন মনে পড়ছে না। সর্বশেষ ১৯৯০ সনে সুনামগঞ্জ কলেজ নির্বাচনে দোলন-মুনিম-কবির পরিষদে আমরা জালালের নেতৃত্বে একত্রিশ ও জালালাবাদে নির্বাচনী ক্যাম্প করে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি। উক্ত নির্বাচনে ভিপি পদে এড. বুরহান উদ্দিন আহমদ দোলন, জি.এস পদে মোজাম্মেল হক মুনিম ও এ.জি.এস পদে গোলাম কবিরসহ অধিকাংশ পদে আমাদের প্যানেল জয়লাভ করে।
জালাল আপাদমস্তক একজন পরোপকারী, অসাম্প্রদায়িক মানুষ এবং সমাজ বদলের একজন লড়াকু সৈনিক ছিল। জালাল কোন কিছু প্রাপ্তি বা বিনিময়ের আশায় এমনকি ‘নাম ফুটাবে’ এই চিন্তা থেকে কোন কিছু করত না। নিঃস্বার্থভাবে সকলের জন্য সারা জীবন করে গেছে। বর্তমান সমাজ বাস্তবতায় যেখানে অধিকাংশ মানুষই ক্ষমতা, টাকা-কড়ি প্রাপ্তির জন্য সকল সময় পেরেশান, সম্পদের পাহাড় গড়ায় ব্যস্ত। সেখানে আমাদের জালাল ছিল একেবারেই ব্যতিক্রম। জালাল ক’বছর আগে সিলেটের উপশহরের মূল্যবান দেড় কোটি টাকার ভূমি সি.আর.পি.-কে (সেন্টার ফর দ্যা রিহেবিলিটেশন অব দ্যা প্যারালাইজড) দান করে গেছে। এই দানকৃত ভূমিতে জালালের আব্বা-আম্মার নামে বর্তমানে ‘ইসকন্দর-সিতারা’ নামে পক্ষাঘাতগ্রস্তদের সেবাদানের জন্য সি.আর.পি. সিলেট কেন্দ্রটি চালু হয়েছে। জালালের মতো এমন মানবিক মানুষ সত্যি বিরল।
ছোটবেলা থেকেই জালালের অসাধারণ নেতৃত্বের গুণ ছিল। কোন সময়ই প্রকাশ্য নেতৃত্বে আসাটাকে পছন্দ করত না। কিন্তু দূরদর্শী চিন্তা থেকে তাঁর সিদ্ধান্তটি সঠিক ও চমৎকার ছিল। শ্বেতকপোত খেলাঘর আসর, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন, উদীচী, অঙ্গীকার বাংলাদেশ, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ বিরোধী আন্দোলন, তেল-গ্যাস-জাতীয় সম্পদ রক্ষা আন্দোলন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ বিরোধী আন্দোলনসহ প্রগতিশীল প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে বিশেষ করে সুনামগঞ্জ এবং সিলেটে নেতৃত্বের আসনে আসীন ছিল জালাল। তাঁর এই সাংগঠনিক মেধা সত্যি বিরল। বাম প্রগতিশীল ছাত্র-যুব ও সাধারণ জনগণের সে এক বিপ্লবী ভরসার স্থল ছিল। স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতির বাহিরে আন্তর্জাতিক যুব উৎসবে জালাল ছিল অনিবার্য। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক যুব উৎসবে যেতে যেতে দেশের বাইরে অনেক প্রগতিশীল ও মানবতাবাদী যুব ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের একান্ত পরিচিত ও আপনজন হয়ে উঠেছিল। প্রান্তিক শহর সুনামগঞ্জ থেকে উঠে এসে বিশ্ব নেতৃত্বের এই সোনালী পালক সত্যিই বিরাট সম্মানের ও গৌরবের।
জালাল বিয়ে করবে করবে বলে প্রচুর সময় নিল। আমরা পাত্রী খুঁজতে খুঁজতে আমাদের বয়স বেড়ে গেছে। ক’বছর আগে জালাল বিয়ের পক্ষে মত দিয়ে বিভিন্ন কথা বলা শুরু করল। বেশ দার্শনিক মার্কা কথাবার্তা, স্পষ্ট করে কিছু বলে না। একদিন জরুরি তলবে সিলেট আম্বরখানায় তাঁর ভাড়া বাসায় গেলাম। ফোন করল, কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর একজন শান্ত, স্নিগ্ধ মায়াবী চেহারার রমণী আমার সামনে উপস্থিত। পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল ‘আমার স্ত্রী নাজিয়া চৌধুরী’। বেশ অনেকক্ষণ গল্প করলাম। পরিকল্পনা হলো কিছুদিনের মধ্যেই সুনামগঞ্জে ঘটা করে বিবাহোত্তর সংবর্ধনা অনুষ্ঠান হবে। সে-মতে সুনামগঞ্জে জাঁকজমকের সাথে অনুষ্ঠান ও খানাপিনায় ‘বন্ধুদায়গ্রস্ত’ দুর্নাম থেকে আমরা রক্ষা পেলাম। সেই থেকে তার স্ত্রী ড. নাজিয়া জালালের পাশে ছায়ার মত থাকতেন। জালালের দেশে-বিদেশে চিকিৎসার জন্য নাজিয়ার চেষ্টার কমতি ছিল না। কিন্তু সে যেতে চাইতো না। নিবিড় চিকিৎসায় থাকা তাঁর ধাতে সইতো না। তাঁর স্ত্রী ড. নাজিয়া চৌধুরীর নির্ভরতায় জালাল বেশ ভালো ও সুস্থ ছিল।
১৮ অক্টোবর ২০১৮ খ্রি. সকাল বেলা সিলেট থেকে এডভোকেট আনোয়ার হোসেন সুমনের মোবাইল কল পাই। কিছু বলার আগেই ফুপিয়ে কেঁদে উঠে বলে জালাল ভাই শিলং-এ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আমাকে এস.এম.এস. করে শিলং-এর মোবাইল নাম্বার দিতে বললাম। শিলং এ কল করলাম। একজন মহিলা কল ধরে বললেন জালাল ভাই শিলং-এর উডল্যান্ড হসপিটালে আই.সি.ইউ.-তে আছেন। পরে ফোন দেন। একটু পর আবার ঘুরালাম। রিং যায় ধরে না। ক্রমাগত ফোন। রিং হয়, উত্তর আসে না। আবারো সেই মহিলা মোবাইল ধরলেন। আমার নাম পরিচয় দিয়ে জালালের স্ত্রী নাজিয়ার কাছে মোবাইল দিতে বললাম। আরো কিছু সময় অপেক্ষা করেন বলে মোবাইল কেটে দিলেন। আমি আবার মোবাইল করি। এবার নাজিয়া ধরলেন। নাজিয়ার অঝোর কান্না আর থামে না। আমিও কাঁদতে লাগলাম। জালাল আর নাই।
আমি ঠিক থাকতে পারলাম না। জালালদের বাসায় গেলাম। তাঁদের পরিবারের কেউ এখন আর সুনামগঞ্জ থাকেন না। বাসার ভিতর হাঁটাহাঁটি করে একত্রিশ নম্বর রুমের বাইরের উত্তর দেয়ালে চোখ পড়তেই আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। বাসার কেয়ারটেকার ছুনুমিয়া হতভম্ব। জালালের সিলেটের বাড়িতে বোনদের খবর কিভাবে দেব। সুনামগঞ্জে বাবলু ভাইদের বাসায় কিভাবে জানাব চিন্তায় পড়ে গেলাম। সিলেটে জালালের বড় ভাগনা সোহাগকে ফোন দিয়ে জালালের গুরুতর অসুস্থতার কথা বলার সময় কান্না চলে আসায় সে হয়ত বুঝে গেল। শিলং-এর মোবাইল নাম্বার তাকে দিলাম। কোর্টে বাবলু ভাইকে ফোন দিয়ে জালালাবাদ হোটেলে আসতে বললাম। মুহূর্তেই ছড়িয়ে গেলো আমাদের আকাশের উজ্জ্বল তারাটি খসে পড়েছে। অন্ধকার নেমে এল। আস্তে আস্তে সুনামগঞ্জের আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-সুহৃদ একে একে সিলেটে রওনা দিলেন। দুপুরের মধ্যেই সিলেটের চৌহাট্টায় জাকির ভাইয়ের বাসায় সিলেট-সুনামগঞ্জের বন্ধু-সুহৃদদের এক বিশাল শোকাতুর সমাবেশ হয়ে গেল। সিদ্ধান্ত মতে সন্ধ্যার দিকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অ্যাম্বুলেন্স ও গাড়ির বহর নিয়ে ভারত সীমান্ত তামাবিল উদ্দেশ্যে সকলেই রওনা হলাম। রাত এগারোটার পর ভারতীয় পুলিশ ও সীমান্ত রক্ষীদের উপস্থিতিতে গাড়ি বদল করে জালালকে আমরা গ্রহণ করি। সে এক গভীর কষ্টের রাত। পাথরচাপা কষ্ট নিয়ে রাত প্রায় দেড়টায় জালালের গ্রামের বাড়ি ধরাধরপুরে আমরা সবাই পৌঁছি। এতো গভীর রাতে জালালের পাশ থেকে কেউ আর সরতে চায় না। যার যার মতো করে জালালকে স্পর্শ করল। বোবা কান্নায় চারপাশ নিস্তব্ধ।
অনেকেই বলেন জালাল অসময়ে চলে গেছেন। আমি বলি মানব দরদী জালালের কোন সময়ই যাওয়া হয় না। জালালের মতো মানুষের আরো আরো দীর্ঘ সময় থাকা প্রয়োজন। পরিশেষে আল্লাহপাকের দরবারে প্রার্থনা করি বন্ধু জালাল যেন বেহেস্তবাসী হয়, চির শান্তিতে থাকে।
[লেখক : সাধারণ সম্পাদক, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি পাবলিক লাইব্রেরি, সুনামগঞ্জ।]