ছাত্রলীগের পর যুবলীগে চালানো হয়েছে শুদ্ধি অভিযান। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাধারণ সম্পাদককে পদচ্যুত করার পর বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুবলীগের প্রতি কঠোর মনোভাব পোষণ করেছেন। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনে সম্পৃক্ত অপকর্মকারীদের ছাঁটাই করে রাজনৈতিক শুদ্ধতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। এর সফলতা মানুষ দেখতে চায়।
গত ১৯ সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা গণভবনে শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি সবার প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘কোনো নালিশ শুনতে চাই না। ছাত্রলীগের পর যুবলীগ ধরেছি। ইমেজ ধ্বংস করতে দেব না। সমাজের অসঙ্গতি এখন দূর করব। নীতি-আদর্শ নিয়ে সবাইকে চলতে হবে। সবার মাঝে আস্থা-বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। উন্নয়ন অগ্রগতির প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী, দুর্নীতিবাজ কেউ রেহাই পাবে না। একে একে এসব ধরতে হবে। জানি কঠিন কাজ; কিন্তু আমি করব।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি কষ্ট করে সবকিছু করছি দেশের জন্য। দেশের উন্নয়ন করছি। এর ওপর কালিমা আসুক সেটা আমি কোনোভাবে হতে দেব না। আমি কাউকেই ছাড়ব না। যদি কেউ বাধা দেয় কাউকে ছাড়া হবে না।’ [সূত্র : দেশ রূপান্তর, ২০.০৯.১৯]
আওয়ামী লীগ ও সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার দৃঢ়চেতা বিপ্লবী বক্তব্য দল দুর্নীতিবাজদের জন্য কঠোর বার্তা, সাবধানী সুর। রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসহীনতার জায়গাটি পুনরুদ্ধারে এটি যুগোপযোগী সঠিক সিদ্ধান্ত বলে ধরে নেওয়া যায়। বর্তমান রাজনীতিতে যে দুর্বৃত্তায়নের খেলা চলছে তা থেকে মুক্তি পেতে হলে কঠোর হওয়ার বিকল্প নেই। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিকভাবে বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও একমাত্র দলীয় কিছু নেতাকর্মীর উচ্ছৃঙ্খল আচরণ, ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত হওয়ায় নেতৃত্ব সফল শেখ হাসিনার বিশাল অর্জন ও উন্নয়ন সফলতা ম্লান থেকে ম্লান হচ্ছে।
দেশে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে এবং হচ্ছে। সেটা কায়মনোবাক্যে স্বীকার করছে মানুষ। কিন্তু বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনকে নেতৃত্ব দেওয়া একটা অংশের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে। এদের কারণে রাজনীতি থেকে সবাই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। বর্তমানে শেখ হাসিনা যে পন্থা অবলম্বন করেছেন তা নিঃসন্দেহে দেশ, মানুষ ও রাজনীতির জন্য পূর্ণ সহায়ক হিসেবে বিবেচিত হবে। সর্বমহলে তা প্রশংসা কুড়াবে বলে ধারণা করছি। তবে অভিযুক্তদের ধরে কিংবা দল থেকে বাদ দিলেই চলবে না, তাদের আশ্রয় ও প্রশ্রয়দাতা মূল হোতাদের চিহ্নিত করে জবাবদিহিসহ কঠিন শাস্তির আওতায় আনতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় ‘বহু হয়েছে, আর রেহাই নেই’ এমনটি প্রতীয়মান হয়েছে।
তিনি স্পষ্টত জানিয়ে দিয়েছেন- ‘আমি কাউকেই ছাড়ব না। যদি কেউ বাধা দেয় তাকেও ছাড়া হবে না।’ এখন শুধু প্রমাণের পালা। আর তা শুরুও হয়ে গেছে। ক্ষমতাসীন দলে থেকে পদ-পদবির প্রভাব খাটিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি করা এবং আখের গোছানোর বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে ‘জিরো টলারেন্স’ অভিযান। এরই ধারাবাহিকতায় পদ হারিয়েছেন ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতা; গ্রেপ্তার হয়েছেন মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও সংগঠনটির আরেক প্রভাবশালী নেতা এসএম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জিকে শামীম। যিনি টেন্ডারবাজ ও চাঁদাবাজ হিসেবে সবার কাছে ব্যাপক পরিচিত। খোদ সরকারপ্রধানের নির্দেশেই চলছে সাঁড়াশি শুদ্ধি অভিযান।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ-যুবলীগে উত্তাল সংবাদ মাধ্যমগুলো। আর এই সংবাদের ক্ষেত্র তৈরি করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই। অপকর্মধারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে গিয়ে তিনি তার স্বচ্ছতার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছেন। তারই প্রেক্ষিতে পত্রিকাগুলো ছাত্রলীগ ব্যস্ততা কাটিয়ে এখন যুবলীগ ক্যাসিনোতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। ছাত্রলীগ শোভন-রব্বানী কাট কাহিনীর পর এবার যুবলীগে হানা দেওয়া হয়েছে। রাজনীতির নামে কি চলছে, চলমান রাজনৈতিক ক্যাসিনোতে কে বা কারা সাহেব বিবি টেক্কার চাল চেলেছেন তা বেরিয়ে আসা শুরু করেছে। এমন ক্যাসিনো খেলায় প্রায় নতজানু দেশের রাজনীতি।
খবরে বলা হয়, ‘রাজধানীতে গড়ে ওঠা অবৈধ ক্যাসিনোতে প্রতিদিন উড়ত কোটি কোটি টাকা। ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা, ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এসব ক্যাসিনো পরিচালিত হত। তাদের কাছে দৈনিক ও মাসিক ভিত্তিতে পৌঁছে যেত এই জুয়ার আসরের টাকার প্যাকেট। দেশের আইনে ক্যাসিনো অবৈধ হলেও তা চলত পুলিশসহ প্রশাসনের বাধা ছাড়াই। আটক জুয়াড়িরা বলেছেন, ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবে জুয়াড়ির ভিড় ৪ গুণ বেড়ে যায়। এ ছাড়া শুক্রবার ছুটির দিন ভিড় দ্বিগুণ হয়। এতে স্পষ্ট, মতিঝিলের শুধু এই একটি ক্লাবেই জুয়ার আসর থেকে লাভের অঙ্ক দাঁড়ায় মাসে কমবেশি ৫ কোটি টাকা। আর ৯টি ক্লাব মিলিয়ে এ অঙ্ক প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা।’ [সূত্র : আমাদের সময়, ২০.০৯.১৯] এই বিপুল অঙ্কের টাকা ভাগবাটোয়ারা হত ক্ষমতাসীন শীর্ষ নেতা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে। যার তালিকা রয়েছে গোয়েন্দাদের হাতে।
রাজনীতি ছিনতাইয়ের বর্তমান সময়ে রাজনীতি নিয়ে একটু ভাবতে হয়। রাজ শব্দের সাথে নীতি যোগ করে রাজনীতির জন্ম হয়েছে। বর্তমান রাজনীতিতে নীতিহীন রাজ রাজত্ব চলছে। ভোগ-বিলাসিতা ও লোভ-লালসার দাপটে রাজনীতি থেকে নীতি শব্দটা হারিয়ে গেছে। যেখানে ব্যাপক হারে নীতির স্খলন ঘটেছে। ভ্রষ্টতার তলে তলিয়ে গেছে রাজনীতির নীতি-নৈতিকতা। নানা অপকর্মে আজ কলঙ্কিত রাজনীতি। ক্ষমতার দাপট, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অস্ত্রবাজি, হাট দখল, ক্লাবে জুয়ার আসরসহ ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত রাজনীতি মাথা উঁচিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেও বারবার পরাস্ত হচ্ছে। রাজনীতিক নামক মন্দ মানুষের অপতৎপরতার বলি রাজনীতিকে নীতির জায়গায় ফিরিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তিনি প্রথমে ছাত্রলীগের স্খলিত দুই শীর্ষ নেতৃত্বকে সরিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ছাত্রলীগে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মতো শীর্ষ পদবীধারী দুই নেতৃত্বকে একসাথে সরিয়ে দেওয়ার ইতিহাস এই প্রথম। যা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দ্বারাই সম্ভব হয়েছে। তিনি ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্য করে পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, ‘সততা ও আদর্শের সঙ্গে পথ চলতে হবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পথে চলতে না পারলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কারোর রাজনীতি করার প্রয়োজন নেই।’ এরই ধারাবাহিকতায় যুবলীগ অতঃপর অন্যদের পালা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যে একটি বার্তা পরিষ্কার- ছাত্রলীগ ও যুবলীগ শুধু নয়, দুর্নীতি করে থাকলে মূল দলেরও কেউ রেহাই পাবেন না। তাদেরও একে একে ধরা হবে এবং আইনের আওতায় আনা হবে।
প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে যুবলীগের বিরুদ্ধে চলমান অভিযান নিয়ে প্রশ্ন তুলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমালোচনা করেছেন যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী। তার সমালোচিত বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের কোন নেতা সরাসরি কিছু না বললেও তারা পত্রিকান্তরে জানিয়েছেন, ‘এ বক্তব্যে খোদ সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। তার এ বক্তব্য সমীচীন হয়নি।’ [সূত্র : আমাদের সময়] এছাড়া যুবলীগ চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ্য করে ফেসবুক ব্যবহকারী একজন তার স্ট্যাটাসে বলেছেন, ‘সময় থাকতে বুঝেন। নেত্রীর কথা মতো চলেন। তা না হলে আপনার আমও যাবে ছালাও যাবে। আপনার থেকে অনেক পাওয়ারফুল বাঘদের বিড়াল হতে দেখেছি। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর মেয়ে সে ভাঙবে তবে মচকাবে না। শুদ্ধি অভিযান যখন শুরু হয়ে গেছে তখন সেটা চলবে।’
সত্যি এবার রেহাই পাবে না কেউ। তবে এ অভিযান কোথায় গিয়ে ঠেকবে তাও পরিষ্কার করে কিছু বলা যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর যুগোপযোগী এ সিদ্ধান্ত আদৌ কতটুকু সফলতা বয়ে আনবে তা নিয়ে সন্দিহান অনেকে। কারণ একজন প্রধানমন্ত্রী কতজনকে সামলাবেন। দিনে দিনে দলে বহু অপবাজদের জন্ম হয়েছে। এই অপতৎপরতাকারী শুধু ঢাকা কিংবা কেন্দ্রীয় পর্যায়েই সীমাবদ্ধ নয়। সারা দেশব্যাপী এদের শিকড় ছড়িয়ে পড়েছে। একেবারে কেন্দ্র থেকে মফস্বল পর্যন্ত এদের অনৈতিক বাহাদুরি টের পাওয়া যাচ্ছে। যেখানে আমার অবস্থান সেখানকার রাজনৈতিক অবস্থার কথা যদি একটু বলি তাহলে হয়তো এর যৎসামান্য বোঝাতে সমর্থ হব। এখানকার রাজনীতিক নামধারী নেতা পাতিনেতাদের লুটেরা মনোবৃত্তি সাধারণ মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে।
উদাহরণ হিসেবে যদি একটু আলোকপাত করি বিষয়টা খোলাসা হবে। যেমন- ঐ নেতারা কিছু একটা কিনতে গেল- জিজ্ঞেস করল- কত? মূল্য নির্ধারণের সামান্য কিছু বিক্রেতার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, বাকিটা পরে দিচ্ছি। ব্যাস এখানেই সমাপ্ত। কিংবা পরিচিত কোন ব্যবসায়ী বা ঘনিষ্ঠজনদের কাছ থেকে প্রয়োজনের কথা বলে টাকা ধার নিল। কিছুদিন চলে যাওয়ার পর টাকা না পেয়ে ধার দেওয়া ব্যক্তিটি চাঁদাবাজির শিকার বলে নিজেকে প্রবোধ দিয়ে সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা করল। অন্যদিকে সরকারি দলের বড় নেতা কিংবা সাংসদ সাহেবদের ডানে-বামে থাকা বল্টু-সল্টু নামধারী কথিত রাজনীতিকের অবৈধ প্রভাব বিস্তারে নাজেহাল মানুষ। তাদের অনৈতিক কাজের বিরোধিতা করলেই যে কারো বারোটা বেজে যাবে। এমন রাজনীতির অস্বস্তিকর বাস্তবতা প্রায় সবখানে। শুধু শীর্ষ পর্যায়ে অভিযান চালালেই চলবে না। রাজনীতিকে রাজনীতির জায়গায় ফিরিয়ে আনতে হলে, বড় পর্যায় থেকে ছোট পর্যায় পর্যন্ত শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে।
কেন্দ্র থেকে শুরু করে প্রতিটি-জেলা উপজেলায় গোয়েন্দাগিরির মাধ্যমে অপতৎপরতাকারীদের চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। জানি, এ কাজ অতিচ্যালেঞ্জিং, তবে অসাধ্যকর নয়। এ জন্য চ্যালেঞ্জ নিয়েই কাজ করতে হবে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার দ্বারা সবকিছুই সম্ভব। যাঁর শরীরে নীতি-আদর্শে বিরল ক্ষমতাধর ব্যক্তিত্ব জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত বহমান। শেখ হাসিনা তাঁর দীর্ঘ ক্ষমতাকালে অসাধ্য অনেক কিছুই করে দেখিয়েছেন। তিনি ভাঙবেন তো মচকাবেন না। সবশেষে, দলের ভেতরে সৃষ্ট আগাছা, পরগাছা ও সুনাম ক্ষুণœকারী দুষ্কর্মকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্তে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা।
[বিশ্বজিত রায়, সাংবাদিক ও কলামিস্ট, জামালগঞ্জ]