সুনামগঞ্জ জেলার সীমানায় প্রবেশের সাথে সাথে একটা অন্য রকম শিহরণ যেকোনো মানুষের মাঝে অনুভূত হতে থাকে। রাস্তার দুই দিকে বিস্তীর্ণ হাওর – তাতে বর্ষায় বিশাল জলরাশি, শুকনো মৌসুমে ধানের ক্ষেতে বাতাসের ঢেউ খেলা। দূরে নীল পর্বতমালা, যতই জেলা শহরের দিকে এগোনো যায়, ততই তা কাছে আসে। প্রকট হয় পাহাড়ের শরীরের রহস্যময় বন রাশি। আর আছে সুরমার রুপালি স্রোত। প্রকৃতির এই তিন রূপ মানবমনের কল্পনা শক্তিকে নাড়া দিয়ে যায়।
আদিকাল থেকেই সুনামগঞ্জের বিকাশের অনুষঙ্গ হিসেবে প্রকৃতিকে মূল্যায়ন করা হতো। একে তাচ্ছিল্য করে নয় বরং প্রকৃতির সাথে মিশে জীবনযাপনেই আমরা অভ্যস্ত। কারণ প্রকৃতিই আমাদের শেষ আশ্রয়স্থল। এভাবেই বংশ পরম্পরায় বেড়ে উঠেছে এই জেলার মানুষ। প্রকৃতির বিশেষ দানই এক সময় একমাত্র জীবন ধারণের উপায় ছিল এই অঞ্চলে।
জেলার প্রাকৃতিক দানের কথা বললেই মাছ ও ধানের কথা আসে। এই দুই জীবনদায়ী খাদ্যের উৎপাদন স্থল হিসেবে আসে হাওরের নাম। মূলত জেলার হাওরগুলোই আমাদের এই ভৌগোলিক অবস্থানকে সমৃদ্ধ করেছে। হাওর সুনামগঞ্জের প্রাণস্বরূপও বলা যায়। তার সাথে সুরমাসহ অন্যান্য নদীও।
হাওর জলাভূমির মূল উৎস হচ্ছে ভারতীয় ২২টি নদী ও পাহাড়ি ছড়ার জলধারা। এক সময় হাওর এলাকার বর্ষা মৌসুমের বন্যার কারণই ছিল ওই পাহাড়ি ঢল। সব হাওরই পানিতে নিমগ্ন হতো এই পাহাড়ি ঢলগুলোর কারণে। গ্রাম্য কৃষিকাজে অভিজ্ঞ মানুষরা জানতেন, বলতে পারতেন এই সব ঢলের গতিধারা বা ঢল নেমে আসার সময়কাল। মোটামুটি একটি নির্দিষ্ট নিয়মনীতি অনুসরণ করে চলতো প্রকৃতির এই ঢলযাত্রা। সে অনুযায়ী কৃষকরা তাদের ফসল বোনা ও উত্তোলনের সময় নির্ধারণ করতেন। এতে করে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা না ঘটলে তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে মেনে চলা নিয়মের ব্যতিক্রম খুব একটা হতো না। কিন্তু গত কয়েক দশক ধরে এই নিয়মধারা আর কাজ করছে না। পাহাড়ি ঢল যখন ইচ্ছা তখন যেকোনো পথ ধরেই হাওরে প্রবেশ করছে। আর এটাই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সৃষ্টি করছে অকাল বন্যা। পরিণতিতে হাওরবাসীর কপালে নেমে আসে প্রায় বছরই দুর্ভোগ। আর এ জন্য দায়ী যেমন সীমান্তের ওপার, তেমনি এপারের মানুষও। পাহাড়ে অবাধে গাছ কাটা চলে। যার সাথে জড়িত আমরাও। পাহাড়ি ওই গাছগুলোর মূল খরিদদার আমরাই। ব্যাপক এই বৃক্ষ ধ্বংসের কারণে পাহাড় হারিয়েছে তার ভারসাম্য। মাটি ধরে রাখতে পারছে না সে। তাই শুধু ঢলই নয়, সাথে আসছে বালিও। এর ফলে বিপন্ন হয়ে পড়ছে হাওর এলাকায় প্রকৃতি, জীবন। শুধু হাওর নয় সাথে সাথে নদীর তলদেশও ভরাট হচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে বালুর চর। হাওরেও এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। হাওরের বিশাল বুকে এতোদিনে জমা হওয়া বালু আর নুড়ির স্তূপ চরভূমির সৃষ্টি করছে। এর অসুবিধা হলো হাওরের বিশাল এলাকাজুড়ে একটা অনাবাদি ভূমির সৃষ্টি হচ্ছে। কৃষি প্রতিবেশ পাল্টে যাচ্ছে ওই এলাকায়। ধানি জমির পরিমাণও কমে যাচ্ছে।
পাহাড়ি ঢলের আরেকটা বিপজ্জনক দিক হচ্ছে নদী ভরাটের ফলে পাড় ভাঙন। নদী তীর বুকে ঢলের বিশাল জলরাশি স্থান দিতে না পেরে উগ্রে দেয়। আর তীব্র ¯্রােতের শক্তি নদীর পাড় ভেঙে আশেপাশের গ্রামগুলোকে বেহাল দশায় নিয়ে পৌঁছায়। এতোদিন শুধু পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, কীর্তিনাশা ইত্যাদি নদীর কথা দেশব্যাপী শোনা গেলেও সীমান্তবর্তী এই নদীগুলোর নামও উঠে আসছে এক্ষণে। যেমন এই জেলার নদী যাদুকাটার কথাই ধরা যাক। প্রতি বছর এ নদীর পাড় ভাঙছে। বিলীন হয়ে যাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। এ নদীর পাড় ঘেঁষেই অদ্বৈত মহাপ্রভুর বাড়ি। সনাতন ধর্মের অনুসারীরা যাদুকাটা নদীকে পবিত্র মনে করেন অদ্বৈত মহাপ্রভুর এক অলৌকিক ঘটনার কারণে। ওই বাড়ি ঘিরেই প্রতি বছর যাদুকাটা নদীতে পণাতীর্থের ¯œানে লক্ষ লক্ষ মানুষ জমায়েত হন। সেই বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে চারবার। বর্তমানের বাড়িটি মূল জায়গা থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে।
এছাড়াও হাওরবাসীর দুর্ভোগও সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে এই পাহাড়ি ঢলের কারণে। এক রাতের মধ্যেই পাহাড়ি ঢলে বাড়ি-ঘরে হাঁটু পরিমাণ, কোথাও কোথাও বুক পরিমাণ বালু ঢুকে যাচ্ছে। পুরো গ্রাম তলিয়ে যাচ্ছে বালুর নিচে।
হাওর জনপদ আজ তাই ক্রমশ বিপর্যয়ের মুখে পতিত হচ্ছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার কারণে সৃষ্ট পাহাড়ি অকাল ঢল আর বালু গ্রাস করে নিচ্ছে এই এলাকার জীবন ও জীবিকা। পাহাড়ের বনভূমি উজাড়সহ উজানে অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ, কয়লা ও পাথরের খনির যথেচ্ছ ব্যবহার বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ি। এই সমস্যার সমাধানে দু’দেশের সংশ্লিষ্টদের মধ্যে একটা সমন্বয় যে জরুরি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
[লেখক : সাধারণ সম্পাদক, সুনামগঞ্জ পরিবেশ আন্দোলন]