কৃষ্ণভক্তের মুখে প্রায়ই শুনি, ‘কানু বিনে গতি নাই’। এই উক্তি ভাববাদে গদ গদ ধর্মপ্রাণ মানুষের উক্তি। আর এদিকে কোনও কোনও রাজনীতিবিদের, অবশ্য তিনি যার পর নাই মুুজিবভক্ত মানুষ, মুখে বার বার উচ্চারিত হতে শুনেছি, ‘বঙ্গবন্ধু বিনে কোনও পথ নেই’। এই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কীছু বলতে গেলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কথা এসে পড়ে, ফেরানো যায় না। একাত্তরে বঙ্গবন্ধু দেশে ছিলেন না, তাঁকে বন্দি করে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে রাখা হয়েছিল, মেরে ফেলবে বলে তাঁর কবর খোঁড়া হয়েছিল। অর্থাৎ শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে অনুপস্থিত ছিলেন। তখন তিনি নিজেও জানতেন না তিনি বন্দি হওয়ার আগে যে-দেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গিয়েছিলেন সে-দেশে তাঁর অনুপস্থিতিটাই সব চেয়ে বড় উপস্থিতি হয়ে গেছে। পশ্চিমা হানাদার বাহিনীকে তখন মোকাবেলা করতে হয়েছে একজন মুজিব নয় সাড়ে সাত কোটি মুজিবকে। পশ্চিমা হানাদার বাহিনী ৯ মাসের প্রতিটি মুহূর্ত অনুভব করেছে তারা লক্ষ লক্ষ মুজিব দ্বারা পরিবেষ্টিত। এই প্রতীকী অর্থে যুদ্ধটা কেবল একজন বঙ্গবন্ধুই করেছিলেন। একাত্তরের যুদ্ধকালে সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রত্যেকই তখন একজন মুজিব হয়ে গিয়েছিল। তখন থেকেই গতিই বলো আর পথই বলো, সব পথ আর গতি একাকার হয়ে বাংলাদেশের গতিপথ একটাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। এখনও তাই সত্যি, ইতিহাস নির্ধারিত বাংলাদেশের একমাত্র নিয়তি।
১০ জানুয়ারি ১৯৭২। পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ ফিরে এলেন বঙ্গবন্ধু। আর দেশে পদার্র্পণের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো তাঁর রাজনীতিক আদর্শ, লক্ষ্য ও সংগ্রামের অব্যাহত পথচলার নিরলস প্রয়াস। পৃথিবীর মানুষ ও পরাজিত রাজাকাররা বুঝতে পারলো শেখ মুজিব একটি অন্যরকম দেশ গড়তে চলেছেন। যে-দেশের প্রতীকী নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘সোনার বাংলা’। এই সোনার বাংলা একজন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল, এই স্বপ্নটি বাংলাভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানে আছে, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি …।’ কিন্তু এই স্বপ্নটি বঙ্গবন্ধুর কোনও ব্যক্তিগত স্বপ্ন ছিল না। এটি ছিল বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে বসবাসকারী সকল মানুষের স্বপ্ন। তিনি ছিলেন এই স্বপ্নটি বাস্তবায়নের রাজনীতিক রূপকার।
আসলে সোনার বাংলা একটি রূপকল্প। বাঙালি জাতিসত্তার হাজার বছরের যাত্রাপথের সংগ্রামী চেতনা থেকে জন্ম নেওয়া একটি রূপকল্প। এই রূপকল্পের বাস্তবায়িত রূপটার একটা আর্থনীতিক রূপরেখা এঁকে বঙ্গবন্ধু তাঁর উদ্দিষ্ট কাজ শুরু করেছিলেন। বাংলাদেশকে সে-রূপরেখা অনুসারে গড়ে তোলতে পারলে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বিন্যাসে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হতো। পৃথিবী শুদ্ধ মানুষ জানে, কাজটা তিনি শুরু করেছিলেন মাত্র, শেষ করে যেতে পারেননি। বাংলাদেশের মানুষকে সে-কাজটা অবশ্যই শেষ করতে হবে যে করেই হোক। এই কাজ শেষ না করার কোনও বিকল্প নেই বাংলাদেশের সমানে। সেটা কী? সেটা সংক্ষেপে কয়েকটি শব্দ বা শব্দগুচ্ছ দ্বারা কীছুটা প্রকাশ করা সম্ভব। এই শব্দ ও শব্দগুচ্ছগুলো যে-ভাব ও কথা আমাদেরকে ব্যক্ত করে, যে-রূপকল্পের স্বপ্ন দেখায় মানুষকে, এই দেশে তারই পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের প্রতিরূপ হতে পারে এমন একটি দেশ যা বিশ্বসেরা দেশের মূর্তিমান উদাহরণ। তেমন দেশ তখনই হতে পারে যখন সে-দেশটিতে নিরক্ষর ও দারিদ্র মানুষ থাকবে না, দেশটি উন্নত-সমৃদ্ধ-সুখী একটি দেশ হবে, দেশটিতে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পের দূষিত হাওয়ায় মানুষকে নিঃশ্বাস নিতে হবে না, দেশটা এমন একটি দেশ হবে যে-দেশে গণতান্ত্রিকতার আবহাওয়া বিরাজ করবে প্রতিটি রাজনীতিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে, আধুনিকতার আলো পৌঁছে যাবে প্রতিটি প্রত্যন্ত গ্রামের মাঠে-ময়দানে-মানুষের অন্তরে অন্তরে আর প্রতিটি মানুষ হবে সোনার মানুষ অর্থাৎ এক নতুন মানুষ। যে-মানুষের চেতনায় শোষণ-নির্যাতন আর দাসত্বযাতনার তাপেদগ্ধ অমানবিকতার কোনও কলঙ্কস্পর্শ থাকবে না। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার মানুষ হবে একেবারেই মুক্ত মানুষ, স্বাধীন মানুষ।
এ সম্পর্কে আর বেশি বাক্য ব্যয়ের দরকার নেই। উপর্যুক্ত বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার রূপকল্পের যতটুকু প্রকাশিত হয়েছে সে-টুকুর বাস্তবায়ন চাট্টিখানি কথা নয়। চাট্টিখানি কথা যে নয় সে-টি বাংলাদেশের মানুষকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। বুঝিয়ে দিয়েছে প্রতিক্রিয়াশীলরা, বিদেশি প্রভু সা¤্রাজ্যবাদের দালাল বিশ্বাসঘাতক রাজাকাররা। স্বাধীনতার পৌনে চার বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে, জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে, আদমজী জোট মিলকে ধ্বংস করে দিয়ে, বঙ্গবন্ধুর জাতীয়করণকৃত জাতীয় সম্পদকে ব্যক্তি মালিকানায় ফিরিয়ে দিয়ে, মৌলবাদী অর্থনীতির বিকাশ ও প্রসার ঘটিয়ে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করে, জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটিয়ে, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি মানুষের মনে নিরন্তর উসকে দিয়ে, দেশকে পাঁচ বার বিশ্বসেরা দুর্নীতিবাজ দেশে পরিণত করে, দেশে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে তারা বুঝিয়ে দিয়েছিল যে, সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখা একটি অপরাধ।
২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার আগে দেশের অবস্থা কতোটা লেজেগোবরে হয়ে পড়েছিল তার একটি উদাহরণ দিচ্ছি। তখন একসময় উন্নয়নের নামে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার বিদেশি ঋণ নেওয়া হয়েছিল। এই ঋণের ৭৫ শতাংশ লোপাট করে ফেলা হয়। অর্থাৎ উন্নয়ন ও জনকল্যাণের নামে টাকা ঋণ এনে উন্নয়নের কোনও কাজ না করেই টাকা নিঃশেষ করা কোনও ধরনের রাজনীতিক নৈতিকতার মধ্যে পড়ে না, এটাকে কেবল লুটপাটতন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করা যায়। উন্নয়নের নামে প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রে এই একই আত্মসাৎক্রিয়া সক্রিয় ছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে আসলে দেশটাকে একটি চেটেপুটে খাওয়ার আইসক্রিম বানিয়ে ফেলেছিল মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা। আর এর বিপরীতে মানুষের নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছিল সস্ত্রাস, হত্যা, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি অর্থাৎ ভাবা যায় না এমন এক আতঙ্কগ্রস্ত জীবন ও নিরাপত্তাহীনতা।
২০০৮-এর শুরুতে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলেন। ইতিপূর্বে তাঁকে বার বার মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে এবং বিভিন্ন সময়ে একটার পর একটা সশস্ত্র আক্রমণ করা হয়েছে। ঘটনাচক্রে প্রতিবারই তিনি বেঁচে গেছেন। সব চেয়ে বড় আক্রমণটি করা হয়েছে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। তাঁর কর্মীরা সেদিন তাঁর চারপাশে দাঁড়িয়ে মানবঢাল তৈরি করে তাঁকে অনিবার্য মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে ছিলেন। এই আক্রমণটি ইতিহাসে গ্রেনেড হামলা বলে পরিচিতি পেয়েছে। শেখ হাসিনার জীবনে মৃত্যুর স্পর্শ থেকে রক্ষা পাওয়ার এই আপতিকতা বাংলাদেশের জন্য একটি আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। তিনি ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার রূপকল্পকে বাস্তবায়নের প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। ইতোমধ্যে সুফল ফলতে শুরু করেছে, দেশ মধ্যআয়ের দেশ বলে বিশ্বসমাজে স্বীকৃতি অর্জন করেছে। আমরা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বাস্তবায়নের পথে কীছুটা হলেও অগ্রসর হয়েছি। দেশটাকে একটা লুটপাটের আখড়া বানানো হয়েছিল, বাংলাদেশ একটি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ও সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিল। শেখ হাসিনা দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের প্রতি শূন্যসহনশীলতার নীতি গ্রহণ করেছেন। যে-নীতি বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার পথে অগ্রসর হওয়ার প্রাথমিক শর্ত। যে-কোনও সাধারণ বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই বোঝেন যে, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসকে সঙ্গী করে কোনও উন্নয়ন হতে পারে না।
যে যাই বলুন, বাংলাদেশকে সুখী সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তোলতে হলে বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত পথেই অগ্রসর হতে হবে, শেষ পর্যন্ত। বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য, বঙ্গবন্ধুর কোনও বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবে যে, যে-প্রকল্প প্রণয়ন করেই দেশের উন্নয়ন করতে চান, ছেড়ে ধরে কিংবা কাটছাঁট করে উন্নয়নের যে-প্রকল্পই নির্ধারণ কিংবা অনুসরণ করা হোক না কেন সে-প্রকল্পই অবধারিতভাবে বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত প্রকল্পেরই প্রতিরূপ হয়ে উঠবে, কোনও না কোনওভাবে। এর কোনও বিকল্প নেই। কারণ তাঁর পরিকল্পিত রূপকল্প কিংবা তাঁর দেশোন্নয়নের সকল ধ্যান-জ্ঞান-কর্ম ছিল পশ্চাদপদ বাংলাদেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করা, দারিদ্র্যমুক্ত করা, উন্নত ও সমৃদ্ধ করা, দেশের সকল মানুষকে সুখী করা। সেই সঙ্গে দেশকে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও আধুনিক দেশ বানানো। এর কোনও বিকল্প নেই, হতে পারে না।