মানিকদা ছিলেন অস্থির সময়ের স্থির লক্ষ্য অর্জনকারী এক বিশাল ব্যক্তিত্ব। গৃহশিক্ষকতায় উল্লম্ফন আনয়নকারী এই বিরল ব্যক্তিত্বের পুরো নাম মানিক লাল রায়। কালো বর্ণের এই কালো মানিক আজীবন ভালো করে গেছেন সমাজের, বিশেষ করে সুনামগঞ্জের এক বৃহত্তর ছাত্র জনগোষ্ঠীর। প্রথাগত শিক্ষায় পরীক্ষা ফেল করার কারণে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ ঝরে পড়ে যায় অর্থাৎ লেখাপড়ার ল্যাঠা চুকে যায়। চিন্তাশীল মানিকদার কাছে বিষয়টি বিষময় হয়ে উঠে। তার লক্ষ্য হয়ে উঠে এই ফেল করা ছাত্রদের পাস করানোর টেকনিক আবিষ্কার। ঠিকই, তিনি কৌশল আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে মানিকদা বোর্ড পরীক্ষার দুটি স্তরে ফেল করে ঝরে পড়ার উপক্রম শিক্ষার্থীদের জন্য হয়ে উঠেন অভয়াশ্রম। তার এ অভয়াশ্রম সুনামগঞ্জে সক্রিয় ছিল একাধারে তিন-চার দশক।
শিক্ষাক্ষেত্রে ঝরে পড়ার উপক্রম শিক্ষার্থীদের সফলতার দ্বারে পৌঁছে দেবার ইতিবাচকতা মানিক লাল রায়কে সুনামগঞ্জ শহরে সুদৃঢ় শিকড় গড়তে সহায়তা করে। ক্রমে ক্রমে নিজের অবস্থান মজবুত করে হয়ে উঠেন সকলের মানিক দা বা মানিক স্যার। আন্দোলন, সংগ্রাম, রাজনীতি, সাহিত্য, নাটক, আলোচনা, প্রকাশনা একদা হেন সৃজনশীলতা ছিল না যেখানে মানিকদার অনুপস্থিতি ছিল। এই কালো মানিক এর জন্ম জামালগঞ্জ থানার ভরতপুর গ্রামে। পিতার নাম গজেন্দ্র লাল রায়। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে জামালগঞ্জ বাই-লেটারেল হাই স্কুল থেকে এস.এস.সি পাস করে বেশ কয়েক বছর সাচনাবাজারে বইয়ের দোকানদারি করেন। পড়াশোনায় দীর্ঘ বিরতি দিয়ে ১৯৭২ সালে সুনামগঞ্জ কলেজ হতে পাস করেন এইচ.এস.সি। এর পরের ঘটনা আরো জ্বলজ্বলে, আরও উজ্জ্বল। দেশ স্বাধীনের পর প্রথম দিকে ঢিলেঢালাভাবে বি.এ পাস চলতে থাকে। ড. আবুল ফজল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হবার পর শক্ত হাতে হাল ধরলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পাসের হার ০২.০৩% এ নেমে আসে। মানিকদা সেই কঠিন সময়ে বি.এ পাস করে সুনামগঞ্জের মান রক্ষা করেন। অনেক কলেজে তখন পাসের হার ছিল শূন্য।
স্বাধীনতা উত্তর সময়টা ছিল উত্তাল বা অস্থির সময়। পুরো আশির দশক ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতায় ভরপুর। এই অস্থির সময়েও প্রচারবিমুখ মুক্তিযোদ্ধা মানিকদার লক্ষ্য থাকে স্থির। সম্পদের মোহ তাকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি। সম্পদের মোহ থাকলে টিউশন বাণিজ্য করে করে নিজের ছাত্রদের দ্বারাই প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি না হোক কয়েকটি প্রাইভেট কলেজ প্রতিষ্ঠা করা কঠিন ছিল না।
মানিক লাল রায় রাজনৈতিকভাবে প্রথমে ছিলেন সি.পি.বি’র অনুসারী। পরে হয়ে যান বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি (এম.এল) হক সাহেবের রাজনীতির ধারক। বিগত শতাব্দী পর্যন্ত এমনভাবেই চলেছেন। তবে ছাত্র পড়ানোর মহৎ কাজে অধিক মনোযোগী হয়ে এক বিশাল সমর্থক গোষ্ঠী গড়ে না তুললে রাজনৈতিক কারণে টিকটিকিরা তাকে যৌবনকালেই জেলের প্রকোষ্ঠে ফেলে রাখতো। তার দলের অন্যান্য নেতাদের দশা এমনই হয়েছে। দলের প্রধান নেতা অতি বৃদ্ধ হয়ে আত্মগোপন অবস্থাতেই মারা যান। লাশ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আনা হলে সুপ্রীম কোর্টের অ্যাডভোকেট মনসুর হাবিব সাহেবের সাথে যেয়ে গোপন রাজনীতির বড় নেতার মরদেহ দেখার ভাগ্য হয়। মানিকদা বাস্তবতাবর্জিত অতিতাত্ত্বিক হননি কখনও। তাই প্রশান্তির সাথে সমাজ, সংসার ও সেবা ধর্ম পালন করেন নির্ভাবনায়। নিখাদ দেশপ্রেমের আলোয় আলোকিত করেছেন তার সন্তান, ছাত্র, বন্ধু, শুভানুধ্যায়ী সবাইকে।
সুনামগঞ্জের সকল ন্যায়ভিত্তিক আন্দোলনে তার অংশগ্রহণ ছিল অবধারিত। পশ্চিম বাজারের মদের পাট্টা স্থানান্তরের আন্দোলন থেকে ভাসানপানিতে মাছ ধরার অধিকার আদায়ের আন্দোলন, বারকি শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে তার অনেক অবদান আছে। পশ্চিম বাজার থেকে মদের পাট্টা স্থানান্তরের এবং তা শহরের বাইরে নবীনগরে চালু করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল সুনামগঞ্জের ১ম জেলা প্রশাসক শেখ শফিকুল ইসলামের আমলে। পাট্টার মালিক গোপাল সাহা এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে বিভাগে রীট আবেদন করে ব্যর্থ হলে পরে আপীল বিভাগে সরকার হেরে যায়। তবে পাট্টার বিপণন জানালার সম্মুখভাগ রাস্তার পাশ থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। প্রকাশ্য বিপণন ব্যবস্থায় কিছুটা পরিবর্তন আসে।
বহুমুখী প্রতিভাধর ও কর্মতৎপর এই মানুষটিকে চিনতে পারি অগ্রজ বন্ধু মুতাসিম আলীর সহচার্যে। মানিকদা খণ্ডকাল মুতাসিম ভাইয়ের বাসায় অবস্থান করে বি.এ পরীক্ষা দেন। যে পরীক্ষার ফলাফল হয়েছিল অবিস্মরণীয়। এরপর ক্রমে ক্রমে ঘনিষ্ঠ হই কমবেশী চিন্তার মিল ছিল বলে। ১৯৭৫ সালে তৎকালীন সরকারের বিশেষ ক্ষমতা আইনে ১৯ বছর বয়সে বিনাবিচারে ৬ মাস সিলেট কারাগারে আটক (ডিটেনশন) থাকার পর অক্টোবরে মুশতাক সরকারের সাধারণ ক্ষমায় জেলমুক্ত হয়ে ২য় দফা এইচ.এস.সি পরীক্ষার সুযোগ হারিয়ে জীবন চলার পথে বিভ্রান্তিতে পড়ে যাই। ছাত্র রাজনীতি আর সাংবাদিকতার নেশায় এর আগে বিজ্ঞান বিভাগ ছেড়ে এক বছর পিছিয়ে মানবিক বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম। জেলজীবনের কারণে ৭৫-এর এইচ.এস.সি পরীক্ষা হাতছাড়া হয়। মুক্ত হয়ে দ্বারস্থ হই মানিকদা’র। বুঝিয়ে বলি, মানিকদা, পড়াশোনায় অনেক গ্যাপ হয়ে গেছে। আমাকে ইংরেজি পড়াতে হবে, তবে আপনার আস্তানায় আসি কিভাবে? লজ্জাতো আছে। নেতাগিরি করে এটা সম্ভব নয়। মানিকদা আন্তরিকভাবে বিষয়টি নিলেন। বললেন, আমি তোমাকে বাসায় যেয়ে ইংরেজি পড়াবো। দুপুর তিনটার পরে। তাই হলো। মানিকদা মাস দুয়েক সাইকেলে চড়ে পশ্চিম বাজার হতে হাছন নগর কুড়িয়ার পাড় এসে আমাকে পড়ান। কিছুদিন পর কর্নেল তাহেরের বিচার প্রস্তুতিকালে আমাদেরকে আবার আত্মগোপনে যেতে হয়। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে ১৯৭৬ সালে এইচ.এস.সি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে হাইয়ার সেকেন্ড ডিভিশনে পাস করি। অনুজ ও বন্ধু হিসেবে মানিকদা’র প্রিয়পাত্র হতে পেরেছিলাম বলে নিজেকে ধন্য মনে করি।
সময়টা সম্ভবত ১৯৯০ হবে। মানিকদা তখন কৃষক সংগ্রাম সমিতির কাজে খুব তৎপর। একদিন রেকর্ডভঙ্গকারী একটি বৃহদাকার গণমিছিল নিয়ে সুনামগঞ্জ শহর প্রদক্ষিণ করে মানিকদা শহীদ মিনারের পাদদেশে সভা করেন। সভা ও মিছিলের উদ্দেশ্য ছিল ধর্মপাশা থানার গাবী গ্রামের জোতদার কর্তৃক ভূমিহীন কৃষক লালচান হত্যার ন্যায়বিচারে দোষীদের ফাঁসি দাবি। লালচান মার্ডার মামলাটি তখন ধর্মপাশা উপজেলা কোর্টে প্রস্তুত হয়ে বিচারের জন্য সুনামগঞ্জ দায়রা জজ আদালতে বদলি হয়ে আসে। ধর্মপাশা, মধ্যনগর হতে শতশত ইঞ্জিন নৌকা ভর্তি মানুষ আসে সুনামগঞ্জে। মিছিল করে তারা জনসভায় মিলিত হয়। মানিকদা জ্বালাময়ী বক্তৃতার মাঝে আহ্বান জানান সহৃদয় কোন আইনজীবী বিনা ফি-তে লালচান মার্ডার মামলা হাতে নিলে তারা ঋণী থাকবেন। আমি সভাস্থল থেকে একটি চিরকুট লিখে মানিকদা’র কাছে পাঠাই। সভা থেকেই মানিকদা আমার নাম ঘোষণা করেন। তৎসময়ে আমি নবীন আইনজীবী হলেও এই মামলা পরিচালনায় খুব মনোযোগী হয়ে উঠি। বিনা ফিতে মামলা চালিয়ে এই মামলার সুবাদে ঢাকা ও সিলেটে আমি একটি আইনজীবী বেল্ট পেয়ে যাই যা পেশাগত জীবনে খুবই কাজে লাগে। সদ্য প্রয়াত প্রবীণ আইনজীবী সিলেটের খ্যাতি সম্পন্ন পিপি ও পরে সিলেট ল’ কলেজের প্রিন্সিপাল মনির উদ্দিন সাহেব ও তার শ্যালক বর্তমানে বিচারপতি এ.এস.এম আব্দুল মুবিন একদিন সুনামগঞ্জে আমার বাসায় আসেন এবং মামলা বিষয়ে আমাকে আগাগোড়া ব্রিফ করেন। লালচান মার্ডার মামলা আমাকে নগদ উপার্জন না দিলেও তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু দিয়েছে। মাধ্যম ছিলেন মানিকদা। মামলায় ৪ জন আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল এবং আপীলে তা বহাল থাকে।
গত দুই দশকে মানিকদা শহরের সোমপাড়া থেকে নিজে বাড়ি বানিয়ে মল্লিকপুরে সুরমা তীরে বসবাস করছেন জানতাম এবং ২/৩ দিন যাওয়াও হয়েছে। অতি সম্প্রতি আবার বাসা বানিয়ে রায়পাড়ায় ফিরেছেন তা জানা ছিল না। ২৬ জুলাই শুক্রবার ভাতিজির বিবাহ উপলক্ষে সুনামগঞ্জে ছিলাম। সকাল ৮টা বাজার কয়েক মিনিট আগে আমার জুনিয়র, অ্যাডভোকেট নিরঞ্জন তালুকদার মোবাইলে জানায় মানিকদা আর নেই। আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন তাৎক্ষণিক মানিকদা’র বাসায় যেয়ে তার মরদেহ দেখার সুযোগ পাই। মানিকদা’র বাসায় থাকতে থাকতেই রিকসা নিয়ে নিরঞ্জন তার স্ত্রী সীমাসহ শোক সন্তপ্ত পরিবারে হাজির হন।
দৃঢ় প্রত্যয়ী, অক্লান্ত পরিশ্রমী, দুর্দান্ত সাহসী, সমাজ বদলের কারিগর, অকুতোভয়, নির্মোহ মানিকদা রোগ-শোককে জয় করেই সত্তর ঊর্ধ্বকাল বেঁচে গেছেন। তরুণদের জন্য রেখে গেছেন দেশপ্রেমের মহান আদর্শ। মানিকদা তুমি সত্যিকার বিজয়ী বীর।
[লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট]