হাওরাঞ্চলের ভূপ্রাকৃতিক বাস্তবতাটাই এমন যে, এখানে মোটামুটি হিসেবে বছরের অর্ধেক সময় মাটি পানির নীচে থাকে। বাকি অর্ধেক সময়টায়, জল সরে গিয়ে মাটি ভেসে উঠলে, হাওরপাড়ের মানুষেরা চাষের কাজ করে সারা বছরের খোরাকী সংগ্রহ করেন। তারপর বর্ষার আগমনে পানিবন্দি জীবনের অফুরন্ত অবসরে মরমিয়া সঙ্গীতসংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে শিকার ও প্রেমচর্চায় নিরত থাকা। অনাদিকাল থেকে হাওরের মানুষের জীবন এমন করেই চলে আসছিল। তখন এখনকার মতো জনসংখ্যা এতো বেশি এবং জীবননির্বাহও ততোটা কঠিন ছিল না। অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদের মজুদ ছিল চারপাশে। বিশেষ প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংঘটিত না হলে মানুষের অনায়াসে চলে যেতো। কিন্তু বর্তমানে অবস্থা পাল্টেছে। জনসংখ্যা বিপুলাকার ধারণ করেছে। হাওরের প্রাকৃতিক সম্পদ এই অতিরিক্ত জনসংখ্যা প্রতিপালনের চাপ এখন আর সইতে পারছে না, প্রকৃতির দেওয়ার ক্ষমতা ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। মনুষ্য আক্রমণে প্রকৃতি এখন প্রতিঘাত হানতে শুরু করছে, সে যারপরনাই কৃপণ হয়ে উঠেছে, ভারসাম্যহীনতার শিকার হচ্ছে মানুষ। বিশেষ করে ভাসানপানির সময়টায় জলের তলের সম্পদ মাছের উপর মানুষের জীবন ধারণের নির্ভরশীলতাটুকুর অনিবার্য প্রতিক্রিয়া মাছের প্রজাতি বিলুপ্তি ঘটাতে শুরু করেছে এবং প্রকারান্তরে মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রকৃতির শত্রু হয়ে উঠেছে।
এই যখন অবস্থা তখন ‘হাওর অঞ্চলের জীবন জীবিকা : সরকারি পরিষেবার ভূমিকা’ শীর্ষক সংলাপে অনেক অনেক প্রস্তাবিত বিষয়ের একটি ছিল : আয়তনে ২০ একরের নীচের জলমহালগুলোকে ইজারা না দিয়ে উন্মুক্ত প্রক্রিয়ায় হাওরবাসীকে মাছ ধরার সুযোগ প্রদান এবং বর্ষাকালের (আসলে মাটি জলের নীচে থাকার পুরো সময়টা, সেটা কমবেশি ছয় মাস) কর্মহীন পরিস্থিতিতে কৃষক-মৎস্যজীবীদের ভিজিডি’র আওতায় নিয়ে এসে মৎস্যসম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। অর্থাৎ ওই সময় মানুষেরা ভিজিডি’র ভর্তুকী খেয়ে বেঁচে থাকবে, জলে মাছ শিকারে নামবে না এবং এই অবসরে মাছ বড় হয়ে উঠবে। কিন্তু প্রস্তাবটিতে মাছ সুরক্ষার কথা বলার আগে বলা হয়েছে উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছ ধরার অধিকার দেওয়ার কথা। যে অধিকারটি মাছের প্রজাতি বিলুপ্তিকে আরও বাড়িয়ে তোলবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই এবং প্রকারান্তরে মৎস্যসম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না, বরং মৎস্যসম্পদ রক্ষার স্বপ্নটি মাঠে মারা যাবে। আসলে এই প্রস্তাবটি সত্যিকার অর্থেই স্ববিরোধী একটি প্রস্তাব।
আমরা মনে করি, দয়া করে হাওরাঞ্চলকে নতুন করে পুঁজির মৃগয়াক্ষেত্র না বানিয়ে, ভিজিডি ব্যবস্থার অধীনে ভর্তুকী না দিয়ে হাওরাঞ্চলের গ্রামগুলোর সমন্বয়ে হাওরের সম্পদকে কাঁচামাল করে একাধারে পরিবেশবান্ধব ও আধুনিক একটি শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা হোক। যাতে হাওরপাড়ের মানুষদেরকে বর্ষার অবসর সময়টায় বেকার থাকতে না হয়, নিজের রোজগার দিয়ে খেয়ে পরে বাঁচতে পারে।