পৃথিবী এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এখনও পর্যন্ত মানুষের জানা সজীব গ্রহ। বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অন্য কোথাও পৃথিবীর মতো কোনও সপ্রাণ গ্রহের খোঁজ এখনও মহাকাশ বিজ্ঞানীরা দিতে পারেননি। পৃথিবীতে প্রথম জীব এককোষী অ্যামিবা থেকে মানুষের আবির্ভাব পর্যন্ত কোটি কোটি কোটি বছর পেরিয়ে গেছে। পৃথিবীর এই সপ্রাণ বিকাশ ছিল নিরন্তর নির্বিঘ্ন এবং অপ্রতিবন্ধক। কিন্তু মানুষই প্রথম প্রাণী পৃথিবীর এই স্বাভাবিক বিকাশের পথে প্রতিবন্ধকতার কাঁটা বিছিয়ে দিয়েছে এবং প্রকারান্তরে পৃথিবীকে নিষ্প্রাণ করে তোলার পথে ঠেলে দিচ্ছে। অর্থাৎ মহাকালের ঘড়ির মাপে আগামী কয়েক মুহূর্তের মধ্যে পৃথিবীতে কোনও প্রাণ থাকবে না, এমন অবস্থার সৃষ্টি হবে। তার সবচেয়ে বড় কারণ আমরা মানুষেরা পৃথিবীকে বৃক্ষশূন্য করে তুলছি। কোনও পরিসংখ্যানের পরোয়াক্কা (পরোয়া + পেতায়াক্কা) না করেই বলা যায়, অর্ধশতাব্দী আগে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে যে-বনজঙ্গল ছিল তা আর নেই, কমেছে কমপক্ষে ৮৫ শতাংশেরও বেশি। সুনামগঞ্জ জেলার বাসিন্দা যাঁর বয়স এখন ৫০ কিংবা ৬০ তিনি একবার অতীতের দিকে তাকালে তাঁর স্মৃতিতে ভেসে উঠবে বনজঙ্গলে সমাবৃত সবুজ জনপদ। বৃক্ষগুল্মলতার সমাহারে ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে তখন ছিল মানবজীবনের পথ পরিক্রমা। এই পথপরিক্রমার হরেক রকমের পাখপাখালি আর জন্তুজানোয়ারের সমারোহে ছিল সরগরম। নদীখালবিল, হাওরবাঁওড়ের তীরেপাড়ে, লোকালয়ের চারপাশে ছিল বৃক্ষগুল্মের ভিড়। এখন এসবের কীছুই নেই। উদ্ভিদহীনতায় আক্রান্ত হয়েছে দেশ।
গতকালের দৈনিক সুনামকণ্ঠে একটি সংবাদশিরোনাম ছিল, ‘বৃক্ষরোপণ সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে’। সংবাদবিবরণের শুরুতেই বলা হয়েছে, ‘জেলাপ্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেছেন, টেকসই উন্নয়নের তিনটি উপাদান রয়েছে। পরিবেশ উন্নয়ন, সামাজিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন। তিনটি একসঙ্গে এগিয়ে নিতে হবে। পরিবেশ বাদ দিয়ে শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে গেলে সামাজিক উন্নয়ন ব্যাহত হবে।’ এই চার বাক্যের মর্মকথা আমাদের জেলার সাধারণ মানুষকে বুঝতে হবে। সাধারণ মানুষকে এই চার বাক্যের বিশেষ করে শেষ বাক্যটিকে যেমন বুঝতে হবে তেমনি জীবনের পদে পদে মেনে চলতে হবে, কার্যত প্রয়োগ করতে হবে। জেলা থেকে দেশ, দেশ থেকে সারা বিশ্বের মানুষকেই তা করতে হবে; পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্যে, মানবসভ্যতাকে বাঁচানোর জন্য।
পৃথিবী এখন বিপন্ন, বিপজ্জনক সময় অতিক্রম করছে। ইতোমধ্যে বিজ্ঞানীরা বলে দিয়েছেন, পৃথিবী মরতে বসেছে। বিশ্বজুড়ে বৃক্ষউজাড়নের কারণে অর্থাৎ বিশ্বে বনজঙ্গলের কমতির কারণে পৃথিবী দিনে দিনে মৃত একটি গ্রহে পরিণত হচ্ছে। এখন পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের বুঝতে হবে পৃথিবীজুড়ে উদ্ভিদের কমতি দিন দিন বাড়ছে, আর উদ্ভিদ যতো কমছে ততো বাড়ছে পৃথিবীর মানুষের বিপদ। এ কথাটি সুনামগঞ্জের মানুষকেও বুঝতে হবে। মানুষের পক্ষ থেকে যদি তা না করা হয় তা হলে বর্তমানে যেমন পরিবেশ দূষণের কারণে ডেঙ্গু মহামারি আকারে আবির্ভূত হয়েছে তেমনি পরিবেশ উন্নয়ন ব্যাহত হওয়ার কারণে প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতা মানুষের অস্তিত্ব বিনাশের মহামারি রূপে আবির্ভূত হবে। প্রাণময় পৃথিবীতে প্রাণের কোনও অস্তিত্ব থাকবে না। মোটকথা মানবসভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে। বিশ্বব্রহ্মা-ের সপ্রাণ সবুজ গ্রহ নিষ্প্রাণ গ্রহে পর্যবশিত হবে। এমন যদি হয় এই মুহূর্তে পৃথিবীর উদ্ভিদজগৎ ধ্বংস হয়ে যায় তবে মানুষসহ সকল জীবপ্রজাতিকে বাঁচতে হবে অক্সিজেন ছাড়া। কারণ উদ্ভিদ পৃথিবীতে অক্সিজেনের উৎস। আর অক্সিজেন ছাড়া জীব বাঁচে না। সুতরাং প্রাণীজগতও ধ্বংস হয়ে যাবে।
বৃক্ষরোপণের সামাজিক আন্দোলনের তাৎপর্য এখানেই। এই আন্দোলন মানুষের জন্য বাধ্যতামূলক। এই আন্দোলনের প্রতি নিষ্ক্রিয়তার অর্থ নিজের পায়ে নিজে কুঠার মারা। আমরা লক্ষ্য করছি জনহিতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে যে-সব কার্যক্রম গ্রহণ করা হয় সাধারণ মানুষ সেসব কার্যক্রম অনুসরণ করেন না বা মানেন না, সে-অনুসারে কাজ করেন না, একদিন মানলেও পরের দিন ইচ্ছে করেই ভুলে যান। গত ক’দিন আগে জেলাপ্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান চালিয়ে আলফাত চত্বরের (স্কয়ার) অবৈধ দখলদার ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। কিন্তু আবার তারা দখল নিতে শুরু করেছেন। এই উচ্ছেদ আর দখলের নাটক শহরবাসী আর কাহাতক অবলোকন করবেন? তাদেরকে কে আবার দখলের অনুমোদন দিলেন? এই ব্যবসায়ীরা জেলাপ্রশাসনের আদেশ অমান্য করছেন কেন? এভাবেই জেলাপ্রশাসক কথিত বৃক্ষরোপণের সামাজিক আন্দোলনও ব্যর্থতায় পর্যবশিত হোক এটা কীছুতেই কাম্য হতে পারে না। এই আন্দোলনকে অব্যাহত রাখার সকল উদ্যোগে জনগণকে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকতে হবে। একমাত্র জনগণই পারেন সার্বিক অর্থে বনায়নকে সার্থক করে তোলতে এবং একমাত্র এই করেই পরিবেশের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। আর পরিবেশের উন্নয়ন ঘটাতে না পারলে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নও ঘটানো সম্ভব হবে না এবং অনিবার্যভাবেই সম্ভব হবে না ফলপ্রসূ সামাজিক উন্নয়ন, প্রকারান্তরে সুখীসমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে।