গতকালের সম্পাদকীয় ছিল বিশেষ শ্রেণির নাগরিকদের ভিআইপি সুবিধা গ্রহণের বিষয়ে। আগেই বলে বলে রাখা ভালো যে, আজকেও সম্পাদকীয়ের বিষয় সে-অবিমৃষ্যকর প্রসঙ্গটিকে ঘিরেই আবর্তিত হবে। এই সুবিধা গ্রহণের আওতায় একজন যুগ্ম সচিবের গাড়ির জন্য অপেক্ষাপর ফেরিতে গুরুতর আহত মুমূর্ষু এক ছাত্র যথাসময়ে চিকিৎসাবঞ্চিত হয়ে অকালে মারা গেছে, তার অসহায় বাবা বা অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের চোখের সামনে। এর চেয়ে উপেক্ষা, অবহেলা আর কী হতে পারে? মুমূর্ষু ছেলেটিকে এবং তার অভিভাবকদেরকে কি ফেরির কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বলে দেওয়া হলো না তোমরা কেউ নও, রাষ্ট্র-সরকার তোমাদেরকে চিনে না, তোমরা নাগরিক হলেও নাগরিকের কোনও অধিকার তোমাদের দেওয়া হবে না। রাষ্ট্র এবং সরকার কেবল চিনে যুগ্ম সচিবকে। এই যুগ্ম সচিব যদিও এই মুমূর্ষু ছেলেটির অভিভাবকদের মতোন লোকেদের পকেটের টাকায় পরিচালিত শিক্ষাব্যবস্থা, প্রশাসনপ্রতিষ্ঠানে সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। এই ছেলেটির অভিভাবকদের মতো মানুষরা দেশে না থাকলে তিনি শিক্ষাগ্রহণের সুযোগটা পেতেন না, চাকরি করার যোগ্যতা তাঁর হতো না, চাকরি পেয়ে বেতন-ভাতা নেবার টাকা তাঁকে রাষ্ট্র দিতে পারতো না।
যে-উপেক্ষাটি করা হলো এটি কী একধরনের অপমান নয়? এই অপমান করার অধিকার ফেরিওয়ালারা পায় কীভাবে। আমরা জানি যুগ্ম সচিব বেমালুম এই ঘটনার সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা সুকৌশলে অস্বীকার করবেন। বলবেন তিনি ফেরিকে অপেক্ষায় রাখার কথা বলেননি। কিন্তু ঘটনাটি কিন্তু অন্য কথা বলে। বলে যে, এই যুগ্ম সচিবের মতো লোকেরা এইভাবে ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মানুষ’-এর সুবিধা নিয়ে থাকেন এবং নিতে নিতে সেটা একটি রেওয়াজে পর্যবশিত হয়েছে এবং এই রেওয়াজটি এতোটাই শক্তিধর যে, মানুষের মৃত্যুর চেয়ে একজন সচিবের কোথাও যাওয়াকে প্রাধান্য দিতে কসুর করে না। মানুষ মরলে মরুক ফেরিকে সচিবের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে। সচিব কেবল এই দেশের নাগরিক অন্য কেউ নয়। অথচ গতকালের পত্রিকায় সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে যে, ‘রাষ্ট্রপতি আর প্রধানমন্ত্রী ছাড়া দেশে কোনো ভিআইপি নেই বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট।’ যদি তাই হয়, তাহলে যাঁরা ‘ভিআইপি’ হয়ে এতোদিন বিশেষ সুযোগ গ্রহণ করেছেন তাঁরা প্রকারান্তরে দেশের মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন এবং সেটা ছিল একেবারেই নির্জলা ক্ষমতার অপব্যবহার। তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
এইসব উদ্ভট ঘটনার সংঘটন আমাদের দেশে নতুন নয়। সরকারি কর্মকর্তা কিংবা মন্ত্রী-উপমন্ত্রী বা কোন সংসদ সদস্য কোথাও কার্মব্যপদেশে গেলে ছাত্রছাত্রী ও লোকজনকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয় রাস্তায়, রাস্তার মোড়ে মোড়ে তোরণ করা হয়। এই বিষদৃশ আচরণ এ দেশে বেশ পুরনো। কেন? এসবের সঙ্গে দেশের সাধারণ নাগরিকের কোনও যোগ থাকে না। বিশেষ এক শ্রেণির লোকেরা এই বিশেষ সুবিধা গ্রহণের সুযোগটি সৃষ্টি করেছেন। এই চর্চা গণতান্ত্রিক নীতিবহির্ভূত। প্রজাতন্ত্রের সকল মানুষকে, সকল নাগরিককে, প্রকারান্তরে অপদস্ত করা। এখানে কেউ কারও চেয়ে বড় নয়। কিন্তু এটা যে গণতান্ত্রিকতা, মানবতা ও ভব্যতার পরিপন্থী সে-খবর যাঁরা রাখার তাঁরা কেউ রাখেন না। কয়েকজন লোককে বিধিবহির্ভূত সম্মান দেখিয়ে প্রকারান্তরে জনসাধারণকে অসম্মান করা কী কোনও রাষ্ট্রনীতি হতে পারে? এই অবহেলার ভাগিদার হওয়ার জন্য কি লোকে এই দেশে, এই রাষ্ট্রে বাস করে? ভোট দেয়? বেতন দিয়ে সরকারি কর্মচারি পোষে? এখানে সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় হলো এই ছাত্রটির অভিভাবকদের বেদনার তীব্রতার কোনও সীমা নেই। এমন অমানবিকতা কী করে সভ্য সমাজে সম্ভব হতে পারে? ভাবা যায় না। তাও এবংবিধ অমানবিকতার সৃষ্টি হচ্ছে সমাজের সবচেয়ে শিক্ষিত ও প্রাগ্রসর লোকজনদের দ্বারা। কল্পনা করুন, রাজাকাররা একটি বাড়ির বৃদ্ধ বাবা-মাকে বেঁধে রেখে তাঁদের সামনে পরিবারের তরুণীটিকে ধর্ষণ করেছে এবং তরুণ ছেলেটিকে গুলি করে ফেলে রেখে গেছে এবং ছেলেটি বাব-মা ও ধর্ষিত বোনের চোখের সামনে কাতরাতে কাতরাতে মরে গেছে, তাঁরা কীছুই করতে পারেনি। এই কষ্টের কী কোনও সীমাপরিসীমা আছে? কেউ বলতে পারেন এর তীব্রতা কতোটা? তিতাস ছেলেটিও তার অভিভাবক-স্বজনদের সামনে এমনি করে মরে গেছে। এই যদি হয় এই দেশের অবস্থা তা হলে সমাজটা সভ্য হলো কোথায়? মনে তো হচ্ছে একধরনের একাত্তরের যুদ্ধকালের মতো বিপন্ন সময়ই অতিক্রম করছে দেশ ও দেশের মানুষ। দেশে অন্যধরনের একটি যুদ্ধকালই চলছে। সমাজটা এগিয়ে কোথায় যাবে? শেখ হাসিনার ২০৪০ সালের উন্নয়নের রূপকল্পানুসারে উন্নত অবস্থায় দেশ পর্যবশিত হলেও কি এই ভিআইপি সুবিধা গ্রহণকারী লোকেরা থেকেই যাবে?