বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার দেশের সার্বিক উন্নয়নের পাশাপাশি দুর্নীতি দমন, মাদক নির্মূল, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ গ্রহণের মাধ্যমে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু সরকারকে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে যেতে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এমন অবস্থায় শুধু সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। রাষ্ট্রের একজন সুনাগরিক হিসেবে আমাদের প্রত্যেককে এগিয়ে আসতে হবে। নিজ নিজ অবস্থান থেকে সকল প্রকার অনিয়ম-দুর্নীতি-অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে, প্রতিরোধ গড়তে হবে।
অপরাধ দমনে শুধু আইন, আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী নয়, পরিবারকেও ভূমিকা রাখতে হবে। আজকাল টেলিভিশন কিংবা খবরের কাগজে চোখ রাখলেই দেখাযায়, আমাদের অধিকাংশ সন্তানেরা (তরুণরা) বিপথগামী হয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন জাগে, কেন তরুণরা এমন পথ বেছে নিচ্ছে? দেখা যাচ্ছে, যারা বিপথগামী হচ্ছে তারা বেশির ভাগই হতাশাগ্রস্ত, নিঃসঙ্গ এবং পারিবারিক নিগ্রহের শিকার। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের করণীয় কি তা নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে।
বাস্তবতা হল- আমাদের অনেক মা-বাবা কর্মব্যস্ততা কিংবা অন্য কোনো কারণে সন্তানকে যথোপযুক্ত কিংবা সময়োপযোগী সঙ্গ দিতে পারছেন না। এতে ছেলে-মেয়েরা পিতা-মাতার আদর-সোহাগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সন্তান নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করছে। আবেগ তাড়িত হয়ে ভিন্ন পথ বেছে নিচ্ছে। বেছে নিচ্ছে কুসঙ্গ, গ্রহণ করছে মাদক নামক মরণ ঔষধ, বেছে নিচ্ছে সন্ত্রাসের পথ। গণমাধ্যম এ ব্যাপারে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। মিডিয়াতে মাদকবিরোধী, সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান কার্যক্রম তুলে ধরা হচ্ছে। দেখানো হচ্ছে- সেই তরুণদের অতীত স্বপ্ন কি ছিল। এসব অবশ্যই ইতিবাচক কার্যক্রম। কিন্তু অনেকক্ষেত্রেই দেখানো হয় না এ অবস্থার কারণ কি কিংবা কি করলে তারা এই পথ থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারবে।
আইন দিয়ে অপরাধ দমন করা যায় বটে কিন্তু সংশোধন করা যাবে কি? কথায় আছে- ‘শাসন করা তারই সাজে, সোহাগ করে যে’। তাই মনে হয় সোহাগ করার অধিকার যেহেতু মা-বাবার বেশি, তাই শাসন করার দায়িত্ব মা-বাবাকেই নিতে হবে। এজন্য সন্তানকে প্রচুর সময় দিতে হবে। তাদের ভাবনাগুলোকে প্রসারিত করার সুযোগ দিতে হবে। নিজেদের (পিতা-মাতার) মতামত সন্তানের উপর চাপিয়ে না দিয়ে বরং তাদের ইতিবাচক মতামতকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
ছেলে-মেয়েকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বানাবো এসব স্বপ্ন পিতা-মাতা না দেখে সন্তানকে স্বপ্ন তৈরির ক্ষেত্র করে দিতে হবে। তাদের মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। কারণ ধর্ম হল সত্যের সূচক। আর শিক্ষা হল সত্যের প্রচারক। তাই শিশুদের ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার উপর আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে।
কোন শিশু যখন অন্যায় করে, আমরা বলি- সে শিশু, সে না বুঝে ওই কাজ করেছে। হ্যাঁ, আমার সমর্থনও ওইদিকেই কিন্তু আমরা যারা অভিভাবক আছি, তারাতো শিশু নই। তাই ভাল-মন্দের, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য বুঝানোর দায়িত্বটা আমাদের উপরই বর্তায়।
প্রবাদ আছে- পোড়া মাটি জোড়া লয় না। অর্থাৎ মাটি শক্ত হয়ে গেলে সে মাটি দিয়ে যেমন হাড়ি বা চুলা বানানো যায় না তেমনি শিশু যখন বড় হয়ে যায় (অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হয়ে যায়) তখন তাকে নৈতিক শিক্ষা দিলেও তেমন একটা পরিবর্তন আসে না। তাই শিশুর শিক্ষা জীবনের শুরুতে মূল্যবোধ এবং নৈতিকতাপূর্ণ আচরণের অনুশীলন ঘটালে পরবর্তী জীবনে তার মধ্যে মানবীয় কল্যাণবোধ জাগ্রত হবে, অনৈতিক আচরণের প্রতি ঘৃণাবোধ জাগ্রত হবে। এ জন্য শিশুকে অবশ্যই বিদ্যালয়ে পাঠাতে হবে। সমাজবিজ্ঞানী জন ভিউ-এর মতে বিদ্যালয় হল- এক ধরনের আদর্শ, মার্জিত, সুন্দর ও সুষম সমাজ।
অপরাধ দমনে শিক্ষার বিকল্প নেই। তাই তো রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, তাকেই বলি শ্রেষ্ঠ শিক্ষা যা কেবল তথ্য পরিবেশন না করে বরং বিশ্বসত্তার সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। তাই মনে হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত নৈতিক অগ্রগতি সাধিত হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র হতে নৈতিক অবক্ষয় তথা অপরাধ প্রবণতা প্রতিহত করা যাবে না। পরিবার যেহেতু শিশু শিক্ষার মূল ভিত্তি তাই পরিবারকেই নৈতিক অবক্ষয় রোধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
[লেখক : গীতশ্রী রায়, প্রধান শিক্ষক, কালীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সুনামগঞ্জ]