রাজন চন্দ ::
জেলার বন্যাকবলিত উপজেলার গ্রামগুলোতে গবাদিপশুর খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে জেলার হাওরপাড়ের গ্রামের কৃষকরা গবাদিপশুর খাদ্য সংকট নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। কৃষকরা জানিয়েছেন বন্যা আক্রান্ত স্থান থেকে গবাদিপশু নিরাপদ স্থানে সরাতে পারলেও খড় সরাতে পারেননি তারা। তাই বর্ষায় জেলার হাওরাঞ্চলের গবাদিপশুর একমাত্র খাদ্য খড় বন্যার পানিতে পচন ধরেছে আবার কোথায়ও ভেসে গেছে। এ কারণে গবাদিপশুর খাদ্য নিয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন তারা। কৃষকদের অভিযোগ গত এক সপ্তাহ ধরে গবাদিপশুর খাদ্য সংকট দেখা দিলেও এ নিয়ে সরকারি কোন তৎপরতা নেই।
জানা যায়, সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে গ্রামগুলোর চারপাশ বর্ষার পানিতে নিমজ্জিত থাকে। হাওর থেকে উৎপাদিত এক ফসলী বোরো ধান হাওরবাসীর সারা বছরের খাদ্য যোগায়। তেমনি এই ধানের খড়ে হাওরপাড়ের গরাদিপশুর সারা বছরের খাদ্য হয়। এই জন্য ধানের খড়গুলো হাওরপাড়ের প্রতিটি কৃষকরে বাড়ির সামনে উঁচু করে বিভিন্ন পদ্ধতিতে সংগ্রহ করে রাখা হয়। কিন্তু বন্যা দেখা দিলে মানুষ ও গবাদিপশু নিরাপদ স্থানে সরে যেতে পারলেও গবাদিপশুর খাবার এই খড় পানিতে নিমজ্জিত হয়ে যায়। আর কয়েকদিন পানিতে নিমজ্জিত থাকলেই এ সকল খড় পচন ধরে। যদিও হাওরপাড়ের গবাদিপশু লালন পালনকারী কৃষকদের কাছে গবাদিপশুর খাবার হিসাবে ব্যবহৃত ধানের খড় খুবই মূল্যবান। কিন্তু যতœ করে রাখা এ সকল খড় যখন বন্যার পানিতে নষ্ট হয়ে পড়ে তখন গবাদিপশুর খাবার নিয়ে অসহায় পড়েন কৃষকরা।
তাহিরপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. উত্তম কুমার সরকার বলেন, তাহিরপুর উপজেলায় বন্যায় গো-খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। তিনি জানান, উপজেলায় এখন পর্যন্ত গবাদিপশুর খাদ্য নিয়ে সরকারি বরাদ্দ নেই। তবে শীঘ্রই বরাদ্দ আসবে।
টাঙ্গুয়ার হাওরপাড়ের ভবানীপুর গ্রামের কৃষক তাপস তালুকদার বলেন, গবাদিপশু আমাদের পরিবারের প্রতিটি সদস্যর মতো গুরুত্বপূর্ণ ও আদরের। কিন্তু বন্যা আসলে মানুষের খাবার নিয়ে প্রশাসনের তৎপরতা থাকলেও গবাদিপশুর খাবার নিয়ে কোন ধরনের তৎপরতা দেখা যায়না। এবারও এ ধরনের কোন তৎপরতা আজ (সোমবার) পর্যন্ত দেখিনি।
জামালগঞ্জ উপজেলার হালির হাওরপাড়ের বন্যাক্রান্ত মদনাকান্দি গ্রামের কৃষাণী প্রীতি রাণী তালুকদার বলেন, আমার তিনটি গরুর সারা বছরের খাবার বাড়ির সামনে টাক্কুয়া (খড় সংগ্রহ রাখার একটি পদ্ধতি) দিয়া রাখছিলাম। বন্যায় ভাসাইয়া নিছে। নিজের খানি নিয়া কষ্ট নাই। কিন্তু গরুর খানি নিয়া জ্বালায় আছি।
তাহিরপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ অধিদফতর সূত্র মতে, পানিবন্দি প্রতিটি পশুর জন্য দিনে এক কেজি দানাদার খাদ্য ও তিন কেজি খড়ের প্রয়োজন। কিন্তু উপজেলার পানিবন্দি প্রায় ২০ হাজার গবাদি পশুর জন্য এখন খাবারের সংকট রয়েছে। তাই এ সকল পশুর স্বাস্থ্যহানি দেখা দিবে।
বন্যা কবলিত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বানভাসি মানুষজন তাদের গবাদি পশু নিয়ে বিভিন্ন বাঁধ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও উঁচু রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছেন। নিজেরা পানিবন্দী থাকলেও গবাদি পশুদের পলিথিন কিংবা কাপড়ের তৈরি ছাউনিতে রাখছেন। অনেকের সেই সামর্থ্যটুকুও না থাকায় গবাদি পশুদের নিয়ে খোলা আকাশের নিচে রাত্রিযাপন করছেন।
তাহিরপুর উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের ইকরামপুর গ্রামের সুভাষ সরকার জানান, বন্যার কারণে আমার ৪টি গরু নিয়ে বিপদে আছি। গরু থাকার জায়গা এবং খাবারের খের (খড়) পানিতে তলিয়ে গেছে। দক্ষিণ বড়দল ইউনিয়নের বড়দল গ্রামের বাসিন্দা সামায়ুন কবির জানায়, বন্যায় কবলিত হয়ে এক সপ্তাহ ধরেই গরুর খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও আমরা এখন পর্যন্ত কোনও গো-খাদ্য সহায়তা পাইনি। ফলে খাদ্য কষ্টে ভুগে স্বাস্থ্যহানি ঘটছে এসব গবাদি পশুর। চারদিকে পানিতে নিমজ্জিত থাকায় প্রাকৃতিক কোন খাবার জোগাড় করাও সম্ভব হচ্ছে না।
তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আপ্তাব উদ্দিন বলেন, উপজেলার একমাত্র স্থায়ী গরুর হাট আমার ইউনিয়নে। ইউনিয়নের অনেক পরিবার গরু পালন করে। কিন্তু এবারের বন্যায় গোটা ইউনিয়ন পানিতে নিমজ্জিত হওয়ায় এখানকার বেশিরভাগ পরিবারের গবাদিপশুর খাবার (খড়) পানিতে নষ্ট হয়ে পড়েছে। এ কারণে গবাদি পশুর খাবার নিয়ে চরম কষ্টে হয়ে পড়েছে কৃষকরা।
দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিশ্বজিত সরকার বলেন, কৃষকের মজুদকৃত খড় পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় শুকনো খড়ের অভাবে অনেকের গবাদি পশু অভুক্ত আছে।
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসিফ ইমতিয়াজ বলেন, সরকার বন্যাক্রান্ত এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত সব কিছু স্বাভাবিক রাখতে জনগণের পাশে থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা করে যাবে। সঙ্গত কারণেই বন্যাক্রান্ত এলাকায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মানুষের খাবার ও নিরাপত্তা নিয়ে এখন বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। শীঘ্রই গবাদিপশুর খাবারের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হবে।