বাদল কৃষ্ণ দাস ::
একটু একটু করে হাওর সা¤্রাজ্য ভরে যাচ্ছে ‘নয়া পানিতে’। সেই সাথে মৎস্য প্রজাতির ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে দিয়েছে একশ্রেণির মৌসুমী জেলে। হাওরের পোনামাছ, ডিমওয়ালা মাছ এবং মৎস্যজাত জলজ স¤পদ সব সাবাড় করে দিতে নৌকা বোঝাই সর্বনাশা কারেন্ট জাল নিয়ে বেপরোয়া মৌসুমি জেলেরা দলে দলে নেমে গেছে জেলার ছোট-বড় বিভিন্ন হাওরে। এবছর ধীরলয়ে হাওর পানিতে ভরে ওঠায় হাওরজুড়ে জলজ ঘাসবনের ঘনত্ব লক্ষ করে কথিত জেলেরা কোণাজাল/কাটাজালের বিকল্প হিসেবে নিষিদ্ধ কারেন্ট জালের আমদানি বাড়িয়েছে। ইতোমধ্যে নিষিদ্ধ কারেন্ট জালের ব্যাপক আমদানি হাওর এলাকার গ্রামে গ্রামে প্রায় সকল মৌসুমি জেলেদের ঘরে পৌঁছে গেছে। আর এসব নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল সরবরাহে ও ক্রয়ে অর্থ বিনিয়োগ করছে আড়ৎদার শ্রেণির পাইকারি মৎস্য ব্যবসায়ীরা। এরা প্রতি বছর এই সময়ে মৌসুমি জেলেদের কাছে জাল-নৌকা ক্রয়ের জন্য অগ্রিম টাকা লগ্নি করে থাকে। পরে প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা লগ্নিদার পাইকাররা পাইকারি দামে মাছ ক্রয় করে বাক্সে-বরফে ঢেকে দূরবর্তী জেলাগুলোতে চালান করে দেয়। এলাকার মাছ এলাকায় থাকে না।
জানা গেছে, সারা জেলায় মৎস্যজীবীর সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ২২ হাজার। এর মধ্যে নিবন্ধিত মৎস্যজীবী ৯২ হাজারের বেশি এবং কার্ডধারী ৭৫ হাজার ৮৯০ জন। এদের কেউ কেউ সারা বছর মৎস্যজীবী, আবার কেউ কেউ খ-কালীন মৌসুমী মৎস্যজীবী। তবে জ্যৈষ্ঠের নয়া পানির আগমন হলে মৌসুমী জেলেরা নির্বিচারে ডিমওয়ালা মাছ ও পোনামাছ শিকারে তৎপর হয়ে ওঠে। এতে মাছের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। যে কারণে মাছের দেশে মাছের আকাল বারো মাস লেগেই থাকে।
জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত এক জরিপে হাওর এলাকায় প্রায় ৯৪ হাজার ২৭৭ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়। এর থেকে প্রায় ৫০ হাজার ৪৫ মেট্রিক টন এলাকার চাহিদা থাকে। উদ্বৃত্ত থাকে প্রায় ৪৪ হাজার মেট্রিক টন মাছ। আর এসব উৎপাদিত মাছের মধ্যে ২০% পুকুরে চাষকৃত এবং ৮০% হাওরের উন্মুক্ত জলাধারে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আমিনুল হক জানান, ভাসমান পানিতে নিষিদ্ধ কাটাজাল/কারেন্ট জাল দিয়ে ডিমওয়ালা মাছ, পোনামাছ নিধন এবং অবৈধ পন্থায় মাছ আহরণ বন্ধে জুলাই/১৮ থেকে জুন/১৯ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে সারা জেলার বিভিন্ন হাওরে- বিলে ২১৪টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে। এসব মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে প্রায় ৬ লাখ ৭৪ হাজার মিটার কারেন্ট জাল ধ্বংস করা হয়েছে। কারেন্ট জাল উৎপাদন- বিপণন-সরবরাহ নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও বিপুল পরিমাণে কারেন্ট জালের আমদানি থেমে নেই। এমতাবস্থায় জেলা ও উপজেলা কেন্দ্রিক মৎস্য বিভাগে জনবল কম থাকায় এসব নিষিদ্ধ মৎস্য আহরণ বন্ধে তাৎক্ষণিক অভিযান চালানো সম্ভব হয় না। যে কারণে পোনামাছ ও ডিমওয়ালা মাছ নির্বিচারে নিধন করায় ক্রমশ উৎপাদন কমে যাচ্ছে। যে বছর হাওরে বেশি পানি হয় সে বছর মাছের উৎপাদনও ভাল হয়। হাওরে পানি কম হলে মাছ উৎপাদন কমে যায়।
সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলে প্রায় ১৪৫ প্রজাতির মাছ ছিল। এখন তা কমে ১২৯ প্রজাতিতে নেমে এসেছে। কিছু প্রজাতির মাছ বিরল ও বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এছাড়া মৎস্য প্রজাতির চিংড়ি, কুচিয়া,কাঁকড়া, কোন কিছুই অবৈধ শিকারির হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আরো জানান, নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল, কোণাজাল দ্বারা পোনামাছ ও ডিমওয়ালা মাছ নিধন বন্ধে সংবাদ পেলেই তাৎক্ষণিক অভিযান চালানো হবে। এছাড়া যে সব লগ্নিধার মাছ ব্যবসায়ীরা এসব নিষিদ্ধ জাল ক্রয়ে টাকা বিনিয়োগ করে থাকে অথবা নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল সরবরাহ করে থাকে তাদের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
হাওর বসতির জনসাধারণের মন্তব্য হচ্ছে, নিজেদের হাওরের মাছ নিজেরা খেতে পারছেন না। অতিলোভী মৎস্য শিকারিরা নিষিদ্ধ পন্থায় সব মাছ নিধন করে অন্যত্র পাঠিয়ে দেয়। এতে মাছের আকাল দেখা দেয় এবং হাওর জনপদের মানুষেরা মাছের আমিষ জাতীয় খাদ্য উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সচেতন মহল জানান, এখনই চলতি জ্যৈষ্ঠের নয়া পানিতে হাওরে নামানো নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল, কোণাজাল আটক করে ধ্বংস করা হোক। সেই সাথে অবৈধ মৎস্য নিধনের অন্তরালে থাকা নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল সরবরাহকারী লগ্নিদার মৎস্য ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হোক।