ঈদের ছুটি শেষ। আবার পত্রিকার কাজ শুরু। ছুটিপূর্ব দৈনিক সুনামকণ্ঠের একটি বৈপ্লবিক সংবাদশিরোনাম ছিল, ‘পরিবহণ মালিক-শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে পরিকল্পনামন্ত্রী ॥ সরকারকে শক্তি ব্যবহারে বাধ্য করবেন না’। এই শিরোনামটি নিয়ে একটা সম্পাদকীয় তাৎক্ষণিক মুহূর্তেই অপরিহার্য ছিল। কিন্তু ঈদ ছুটির কারণে তা হয়ে ওঠেনি, বিলম্বে হলেও মনে হয় প্রসঙ্গটি পুরোনো হয়ে যায়নি। বিলম্ব অনেক কীছুকেই মূল্যহীন করে তোলে ও তার তাৎপর্য কমিয়ে দেয়। কিন্তু আজকের সম্পাদকীয়র প্রসঙ্গটি এমন ক্ষণভঙ্গুর কীছু নয়, কালের ব্যবধানে এর সামাজিক ও আর্থনীতিক তাৎপর্য তরল কিংবা ফিকে হয়ে যাবে।
পুঁজিবাদের ছায়াতলে রাষ্ট্র কিংবা সরকার পুঁজির দাসত্ব করে। বিখ্যাত নাট্যকার বার্নাড শ এই দাসত্বের স্বরূপটি তাঁর একটি নাটকে উন্মোচন করেছেন। গল্পটা এরকম : একজন পুঁজিপতির পুত্র সংসদ সদস্য হয়েছে। সে তার বাপ ও বাপের বন্ধুর কাছে নিজেকে রাষ্ট্রপরিচালক বলে ঘোষণা করে, তার বাপ ও বাপের বন্ধুর এ ব্যাপারে কোনওই ভূমিকা নেই। পুঁজিপতি তার ছেলের এই বাগাড়ম্বরের বিরুদ্ধে এই যুক্তি দাঁড় করায় যে, প্রকৃতপ্রস্তাবে পুঁজিপতি ও তার বন্ধু তারা এই দু’জন মিলে রাষ্ট্র চালায়। কারণ সংসদের বাইরে থেকে তারা দু’জন যা চায় সংসদের ভেতরে সংসদ সদস্যরা বহু তর্কবিতর্কের পর সেটাই সিদ্ধান্তরূপে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। তারা যদি চায় চালের দাম বাড়বে তবে বাড়বে, যদি চায় কমবে তবে কমবে। সেটা সংসদ সদস্যরা সংসদে বসে পুঁজিপতিদের ইচ্ছানুসারে ঠিক করবে মাত্র, এটাই সংসদের কাজ, এ জন্যই সংসদ সৃষ্টি করা হয়েছে এবং এ জন্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং সংসদ সদস্যদেরকে নির্বাচিত করে সংসদে পাঠানো হয়। কাজে কাজেই পুঁজিপতিদের এই রাজনীতিক আদর্শের নিরিখে সংসদ সদস্যদের কাজ হলো, সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কে বিআরটিসি’র বাস চালানো বন্ধ রাখার পক্ষে সমর্থন দান, কারণ পুঁজিপতিরা (এখানে পরিবহণ মালিকরা) এটা চাইছেন। কিন্তু পুঁজিপতিদের পক্ষ থেকে বিআরটিসি’র বাস চলাচলের বিরোধিতাকে একরূপ আক্ষরিক অর্থেই উড়িয়ে দিয়ে পুঁজিপতিদের রাজনীতিক সংস্কৃতির নিরিখে রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার প্রতিষ্ঠিত নীতিকে উপেক্ষা করা হয়েছে কেবল নয় বরং কার্যত বাতিল করে দেওয়া হয়েছে এবং প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে জনগণের স্বার্থের নিরিখে রাষ্ট্র ও সরকার চলবে এই বৈপ্লবিক নীতি। আপাতদৃষ্টিতে তাই বলতেই হয়, পরিকল্পনামন্ত্রীর বক্তব্যটি অবশ্যই বৈপ্লবিক। কিন্তু সেই সঙ্গে ভুলে গেলে চলবে না যে, বাংলাদেশ পুঁজিবাদী বিকাশের পথ ধরেই ২০৪০ সালে উন্নত দেশ হওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে এবং সেটাকে সার্থক করে তোলতে হলে অবশ্যই সুনামগঞ্জকে পশ্চাৎপদ রেখে সম্ভব হবে না। এই দিকের বিবেচনায়, সুনামগঞ্জের পরিবহণ মালিকরা পুঁজিপতি হওয়ার পরও উন্নত পুঁজিতন্ত্রের বিরোধিতা করে একধরনের উন্নয়ন বিরোধিতা করে চরম রক্ষণশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁদের বিষয়টি নিয়ে আরও সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা করা উচিত ছিল। বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করার শেখ হাসিনার স্বপ্ন পূরণের সহযাত্রী সৈনিক আমাদের পরিকল্পনামন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, ‘আপনারা আধুনিকতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবেন না।’
আমরা বলি বাংলাদেশ আধুনিক হবে, সুনামগঞ্জও আধুনিক হতে চায়। আধুনিক বাসযাত্রীসেবা পরিবেশন করার সক্ষমতা অর্জন করুন, আমাদের বিআরটিসি’র দরকার নেই। কিন্তু বিআরটিসি যে-উন্নত যাত্রীসেবাটা দেবে সেটা সুনামগঞ্জের পরিবহণ মালিকরা কার্যত দিতে পারবেন না, অথচ বিআরটিসি বন্ধ রাখার দাবি তোলবেন, এমন হতে পারে না। এর নৈতিক ভিত্তিটা কী? এটা কি পচা খেজুর খাওয়ানোর অধিকার দাবি করে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালতকে প্রতিরোধ করার মতো অনৈতিকতা নয়? যে-টা কীছুদিন আগে সুনামগঞ্জের আলফাত স্কয়ার এলাকায় সংঘটিত হয়েছিল এবং পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। মুনাফা অর্জন ব্যবসায়ীর বৈধ অধিকার। কারণ ব্যবসায় একটা সেবা বলে স্বীকৃত। কিন্তু সেবার নামে পচা খেজুর খাইয়ে মানুষকে ব্যাধিগ্রস্ত করা এবং লক্করঝক্কর মার্কা বাস সড়কে নামিয়ে উন্নত বাসের যাত্রীসেবা মানের ভাড়া আদায় করে যাত্রীদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করা ব্যবসায়ের কোনও নীতি নয়, এ দু’টিই শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য এবং নৈতিকতাবিরোধীও। আমাদের বক্তব্য একটাই : দু’টি পয়সা কামানোর লোভে সুনামগঞ্জকে আধুনিক যাত্রীসেবা থেকে বঞ্চিত করার কোনও অধিকার কারও নেই।