প্রতি বছর নিয়ম করে ঈদ আসে। এবারও এসেছে। ঈদ আসে ঈদের মতো করেই। সারা বিশ্বে মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে যে-ঈদ আসে, ঐশীচেতনার দিক থেকে তার স্বরূপ একটাই, কোনও ভিন্নতা নেই। এই স্বরূপের রূপ আনন্দের অপার ব্যাপ্তির মধ্যেই কেবল বিস্তৃত। কিন্তু স্থানকালপাত্র ভেদে মানুষের জন্য অবতীর্ণ ঈদের ঐশীচেতনাগত আনন্দস্বরূপ সওগাত ভিন্ন ভিন্ন স্বরূপে আবির্ভূত হয় এবং সেটাই স্বাভাবিক। অর্থনীতি মানুষের জীবনের চালিকাশক্তি। এই চালিকাশক্তির তাপেচাপে পড়ে ঈদ তার স্বরূপ বদলাতে বাধ্য হয়, সে প্রকৃতপ্রস্তাবে স্থানকালপাত্রভেদে বদলে যায়, জনে জনে ভিন্ন রূপে আবির্ভূত হয়। সৌদি আরব, ফিলিস্তিন, কিংবা দুর্ভিক্ষ পীড়িত কোনও আফ্রিকান দেশ ও বাংলাদেশে উদযাপিত ঈদের মধ্যে তফাৎ আকাশ-পাতাল। যে-ফিলিস্তিনি ইজরাইলের সামরিক শক্তির কবলে মৃত্যুর ভয়াল উপত্যকায় পর্যবসিত হয়ে আছে সেখানে ঈদ বিষাদের বিষণœ রঙে রঞ্জিত হতে বাধ্য। সেখানে সন্তানের লাশ কাঁধে বহনকরা পিতার কাছে ঈদ কী করে আনন্দের অপার সওগাত নিয়ে হাজির হতে পারে? সেটা কোনওভাবেই সম্ভব নয়। কিংবা বাংলাদেশে যে-কৃষক সারা বছর নিরলস পরিশ্রমে ঘাম ঝরিয়ে ধান উৎপাদন করে ধানের উচিতমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে, উৎপাদন খরচের কম দামে তাকে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে ফড়িয়াদের কাছে, সে-কৃষকের ঘরে ঈদ আবির্ভূত হয়ে চোখের নোনাজলে সিক্ত হয়ে উঠবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
সকলেই জানেন ঈদের অর্থ আনন্দ। মুসলমানরা ঈদ করেন বৎসরে দুইটি। এই দুই দিন আনন্দের জন্য নির্দিষ্ট। অথচ প্রতিবেশী সনাতনধর্মীরা বারো মাসে তেরো পার্বণের অধিক আনন্দানুষ্ঠান করে থাকেন। তা যা-ই হোক, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে মুসলমানরা ঈদের অনুষ্ঠানে নিজেদেরকে নিয়োজিত করেন নিজ নিজ আর্থিক সামর্থ্যরে উপর নির্ভর করে। তাই ধনবৈষম্যের নিরিখে এখানে মানুষের মধ্যে ঈদের আনন্দ উপভোগেরও তারতম্য ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন। একজন রিকসাওয়ালার ও একজন কোটিপতির ঈদের আনন্দ উপভোগের মাত্রা কখনওই সমান হতে পারে না। এই আনন্দের সমবণ্টন তখনই সম্ভব হবে যখন সামাজিক সম্পদের সমবণ্টন সম্ভব করে তোলা হবে, তার আগে নয়।
বর্তমানে বিদ্যমান শ্রেণিবিভক্ত সমাজে শ্রেণিস্তর নির্বিশেষে ঈদের আনন্দের সমরূপতার আশা আমরা করি না। তারপরেও সকল ঘরে ঘরে ঈদের আনন্দ ব্যক্তির নিজস্বতার সামর্থের শক্তিতে প্রদীপ্ত হয়ে নির্মলানন্দময় হয়ে উঠুক এই কামনা করি।