‘প্রাইভেট ক্লিনিকে সিজারের হার ৮৭ শতাংশ’ এইরূপ একটি উপশিরোনামসহ গতকালের দৈনিক সুনামকণ্ঠের শীর্ষ সংবাদশিরোনাম ছিল, “ক্লিনিকে ‘সিজার’ বাণিজ্য”। প্রতিবেদনের শুরুতেই লেখা হয়েছে, ‘সুনামগঞ্জে স্বাভাবিক প্রসবের তুলনায় সিজারিয়ান পদ্ধতিতে সন্তান জন্মদানের হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে।’ এই সংবাদে পরিবেশিত চিকিৎসা পরিস্থিতিটি কেবল সুনামগঞ্জের ক্ষেত্রে নয়, সারাদেশের ক্ষেত্রেই সত্য। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে অধিক মুনাফা অর্জনের অভিপ্রায়ে নির্মমভাবে অমানবিক করে তোলা হয়েছে, অর্থাৎ চিকিৎসাপণ্য ও সেবার বাজারদর এতোটাই বেড়েছে যে, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে চিকিৎসার সকল সুযোগ-সুবিধা। নিত্যপ্রয়োজনীয় চিকিৎসাপণ্যের (ঔষধসহ অন্যান্য সেবা) বাজারদর উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু তাই নয়, সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে প্রসূতিগণের সম্ভাব্য স্বাভাবিক প্রসব প্রক্রিয়াকে অকারণে জটিল করে দেয়া হচ্ছে বা সংশ্লিষ্ট প্রসূতির অভিভাবকদের কাছে সিজারের প্রয়োজনীয়তাকে অকারণে অনিবার্য করে তেলা হচ্ছে। অর্থাৎ চিকিৎসাবিদ্যানুসারে স্বাভাবিক উপায়ে প্রসব সম্ভব করে তোলার কোনও চেষ্টা না করেই, চূড়ান্ত পর্যায়ে, প্রসূতির স্বাভাবিক প্রসব অবস্থাকে জটিল প্রতিপন্ন করে সিজারের মাধ্যমে সন্তানভূমিষ্টের চিকিৎসা সম্পন্ন করে সিজারের উচ্চমূল্য আদায় করা হচ্ছে, যাকে বলে গরিবের পকেট কাটা চিকিৎসা। ব্যতিক্রম ভিন্ন প্রসূতির সন্তানভূমিষ্টকরণের চিকিৎসাকে নির্বিচারে সিজার করা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার নীতি যে-কোনও বিবেচনায় চিকিৎসাবিদ্যার নীতিবিরুদ্ধ, একটি ক্ষমার অযোগ্য অন্যায়।
দেশের চিকিৎসা বাণিজ্যিকীকরণের এই আর্থনীতিক বাস্তবতা এই কথা বলে দেয় যে, বাংলাদেশের সামগ্রিক আর্থব্যবস্থাকে ইতোমধ্যে এমনভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে যে, মানুষের মৌলিক চাহিদাকে দামি পণ্য করে তোলা হয়েছে, মৌলিক চাহিদাকে পণ্য করে তোলার পাশাপাশি চাহিদাগুলোকে চড়া দামে বিক্রি করার বাণিজ্যিক পরিসর তৈরি করে বিশেষ করে গরিব মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের সুযোগের সংকোচননীতি কার্যকর করা হয়েছে এবং প্রকারান্তরে গরিব মানুষদেরকে শোষণের মাত্রাকে তীব্র থেকে আরও তীব্রতর করে তোলা হয়েছে। অথচ রাষ্ট্রনীতি হওয়া উচিত এমন জনকল্যাণধর্মী, যাতে দিনে দিনে বিশেষ করে শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবার খরচ কমতে কমতে শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। রাষ্ট্রের ভেতর এই দু’টি চাহিদা পরিপূর্ণ হলে রাষ্ট্র সুস্থ ও শিক্ষিত নাগরিক লাভ করে এবং সুস্থ ও শিক্ষিত নাগরিক হলো রাষ্ট্রের উন্নতির আসল চাবিকাঠি, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। নাগরিককে অসুস্থ ও অশিক্ষিত রেখে কোনও রাষ্ট্র উন্নত রাষ্ট্র হতে পারে না। এইরূপ কল্যাণকর রাষ্ট্রনীতির নিরিখে রাষ্ট্র পরিচালিত না হলে রাষ্ট্র ধনী রাষ্ট্র হতে পারবে বটে কিন্তু উন্নত রাষ্ট্র হতে পারবে না, প্রকারান্তরে রাষ্ট্র হয়ে উঠবে নাগরিক নির্যাতক। আমাদের চাই একটি কল্যাণরাষ্ট্র, যে-রাষ্ট্রের ভেতরে অন্তত মোটা অঙ্কের টাকা উপার্জনের অনুপ্রেরণায় অপ্রয়োজনীয় কাটাছেঁড়ার (তথাকথিত অপারেশন) মাধ্যমে সন্তান ভূমিষ্টকরণের তথাকথিত (সন্দেহ হয়, চিকিৎসাশাস্ত্রানুসারে সেটা চিকিৎসা কি না) চিকিৎসা পরিচালিত হবে না। ক্লিনিকে ক্লিনিকে বর্তমানে যেমন প্রসূতিদের সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে দেদার অপ্রয়োজনীয় সিজার করার নিয়ম চলে আসছে, সেটা চিকিৎসাবিদ্যার নীতিবিরুদ্ধ একটি প্রক্রিয়া এবং সামগ্রিক বিবেচনায় একটি অন্যায়। এই অন্যায়ের প্রতিকার করা অবশ্যই একটি জাতীয় কর্তব্য। সরকারের পক্ষ থেকে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, ইয়াবা, খাদ্যে ভেজালের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। প্রসূতিদের সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে দেদার অপ্রয়োজনীয় সিজার করার অপচিকিৎসাটিও একটি দুর্নীতি। এই অপচিকিৎসা অচিরেই নির্মূলের ব্যবস্থা করা সমীচীন এই জন্যে যে, এই পদ্ধতিটির আবিষ্কার মানবকল্যাণের (বিশেষ করে প্রসূতি ও শিশুর কল্যাণের) শুভচিন্তা থেকে হয়নি বরং এর পেছনে সীমাহীন অর্থলোভ বিদ্যমান, এটি বলতে গেলে চক্রবৃদ্ধি সুদের ব্যবসা থেকেও জঘন্য ও খতরনাক।