ডা. প্রিয়াংকা তালুকদার শান্তা। বাড়ি সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জস্থ গঙ্গাধরপুর গ্রামে। পেশায় চিকিৎসক, ছিলেন সংস্কৃতিকর্মী। হতে চেয়েছিলেন মুমূর্ষু মানুষের প্রকৃত বন্ধু। সেবার ব্রতচারী নেশা আর পরনির্ভরশীল আবদ্ধ চৌকাঠ পেরোনোর অগাধ মানসিকতা যাঁকে চিকিৎসক হতে সহায়তা করেছে। ব্যাংক কর্মকর্তা ঋষিকেশ তালুকদারের সন্তান প্রিয়াংকা তালুকদার চিকিৎসক হয়ে মানুষের রোগ নিরাময় করে খ্যাতি কুড়ানোর আগেই আমাদের ধূর্ত সমাজ ও পারিবারিক পীড়ন পরাকাষ্ঠা নীতি চিরতরে মুছে দিয়েছে মেধাবী প্রিয়াংকার জীবন প্রদীপের প্রজ্জলিত আভা। এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর জন্যই কি প্রিয়াংকা তৈরি করেছিলেন নিজেকে? নাকি ঊনত্রিশ বয়সী ওই তরতাজা মেয়ে- মৃত্যু নয়, সেবার স্টেথস্কোপে রোগ নির্ণায়ক অন্যের জীবন রক্ষাকারী আদর্শ মানুষ হিসেবে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিলেন। বাঁচতে চেয়েছিলেন সুখ, শান্তি ও সম্মান নিয়ে। হৃদয়ে লালন করেছিলেন একজন অনুকরণীয় মানুষের দৃষ্টান্তনির্ভর স্বপ্ন। সেই জায়গা থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে চিরতরে। শ্বশুর-শাশুড়ি কর্তৃক অত্যাচার অসহনীয় যন্ত্রণার শিকার প্রিয়াংকার এমন পরিণতি মেনে নিতে পারছে না সিলেট-সুনামগঞ্জের মানুষ। রহস্যজনক এ মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবি জানিয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে আসছে এলাকার বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। মানববন্ধন-বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানানোর পাশাপাশি চাওয়া হচ্ছে বিচার।
প্রিয়াংকা প্রশ্নে উত্তাল সিলেট ও সুনামগঞ্জ। এই অস্বাভাবিক মৃত্যু মানুষের মনে ক্ষোভের সঞ্চার ঘটিয়েছে। পত্রিকান্তরে উঠে এসেছে প্রিয়াংকার মৃত্যু কাহিনী। ডা. প্রিয়াংকা ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলেন সুভাষ চন্দ্র দেব ও রতœা রাণী দেবের ছেলে দিবাকর দেব কল্লোলকে। বিয়ের পর থেকে প্রিয়াংকা স্বামীর বাসাতে থেকে পার্কভিউ মেডিকেল কলেজে শিক্ষকতা করতেন। মূলত ছেলে কল্লোল নিজের পছন্দের মেয়ে প্রিয়াংকাকে বিয়ে করায় বিষয়টি মেনে নেননি শাশুড়ি রতœা রাণী। এ নিয়ে বিয়ের পর থেকেই তাদের পরিবারে অশান্তি চলে আসছিল। এরই মাঝে প্রিয়াংকা ছেলে সন্তানের জন্ম দেন। যার বয়স এখন তিন বছর। এরপরও স্বামীর পরিবারের লোকজন প্রিয়াংকার ওপর নির্যাতন কমাননি। এক পর্যায়ে প্রিয়াংকাকে হাসপাতালে চাকরি করতে নিষেধ করে দেন শাশুড়ি রতœা। অথচ তিনি তার নিজের ডাক্তার মেয়েকে ঠিকই চাকরিতে দেন। চাকরি ছাড়ার নির্দেশ মেনে নিতে পারেননি প্রিয়াংকা। বিষয়টি নিয়ে তাদের পরিবারের মধ্যে বিরোধ তীব্র হয়। পরবর্তীতে গত ১২ মে সকালে প্রিয়াংকার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়।
সিলেট পার্কভিউ মেডিকেল কলেজের ফিজিওলজি বিভাগের প্রভাষক ডা. প্রিয়াংকার বাবা হৃষীকেশ তালুকদার জানিয়েছেন, তার মেয়ে সিলেট নগরীর পাঠানটুলায় স্বামী ও তার পরিবারের সঙ্গে থাকত। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের নির্যাতনে প্রিয়াংকা অতিষ্ঠ ছিল। প্রায়ই সুনামগঞ্জের নতুনপাড়াস্থ বাবার বাড়িতে চলে আসত সে। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সংসার টিকিয়ে রেখেছিল প্রিয়াংকা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। [সূত্র : মানবজমিন, ১৪.০৫.১৯]
প্রিয়াংকাদের জন্ম বুঝি অত্যাচার অভিসারে নিঃশেষ হওয়ার জন্য। যা ইচ্ছে তাই বস্তু মনে করে এ সমাজ-পরিবার হামলে পড়ছে ওদের ওপর। প্রতিবাদ-প্রতিরোধ কিংবা অনীহা প্রকাশ করলেই নেমে আসছে ঘোর মৃত্যু অমানিশা। নানা উৎপীড়ন উপদ্রব থেকে শুরু করে বিকৃত লালসা মেটানোর সস্তা পণ্য হিসেবে মেয়েরা ব্যবহার হচ্ছে। আমাদের সমাজ পরিবারে ঘাপটি মেরে থাকা বদ চিন্তা-চেতনা ও লোভ-লালসাগ্রস্ত মন্দ মানুষের দুষ্কর্মধারী অমানবিকতায় ধ্বংস হচ্ছে প্রিয়াংকা, নুসরাত, শাহিনুরসহ কতো কোমল প্রাণ। মেয়েদের জন্য রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার কোনোটিই যেন আজ নিরাপদ নয়। ঘর-বাইরে নানা রকম পাশবিকতার শিকার হচ্ছে তারা। কেউবা ঘরে, কেউবা পথে, কেউবা স্কুল-কলেজ কিংবা কর্মস্থলে। স্বামী সোহাগা পরিবারে থেকেও সুস্থ-সুন্দর জীবনের নিশ্চয়তা মিলছে না। সুনামগঞ্জের জন্মভিটে আপনজন ছেড়ে যে মেয়েটি সিলেটের শ্বশুরালয়ে দ্বিতীয় জীবন শুরু করল, সেই স্বামী সংসার বাবা-মায়ের দ্বিতীয় বাড়িটি হবে জমালয় সেটা কি ভাবা যায়।
প্রিয়াংকা নামের যে মেয়েটিকে পারিবারিক কষাঘাতে ধ্বংস করা হয়েছে সে কারো বোন, কারো কন্যা। সর্বশেষ পরিচয় তিনি গৃহবধূ। এই পরিচয়টুকুই কাল হলো প্রিয়াংকার জন্য। প্রেম পরিণয় অতঃপর সংসার জীবনে হয়তো তিনি বধূ হিসেবেই থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শাশুড়ির গোঁড়ামি ভাবনা কিংবা জিঘাংসা মেটানোর একতরফা আচরণ একটি সম্ভাবনাময় আগামীর উজ্জ্বল প্রাণপ্রদীপকে নিভিয়ে দিয়েছে। চিরতরে ভেঙে ফেলা হয়েছে পরম মমতায় যোগ্যতর হিসেবে গড়ে তোলা বাবা-মায়ের একজোড়া বক্ষপাঁজর। আর মাতৃমায়াশূন্য করা হয়েছে তিন বছরের শিশু সন্তান কাব্যকে।
তবে সবচেয়ে হাস্যকর বিষয় হচ্ছে, দজ্জাল শাশুড়ি রতœা রাণী পুত্রবধূকে হাসপাতালের চাকরি অর্থাৎ ডাক্তারি পেশা ছেড়ে দিতে অত্যাচার শুরু করলেও নিজের ডাক্তার মেয়েকে চাকরি ছাড়তে বলেননি। তাহলে নিজের চিকিৎসক মেয়েকে সুযোগ দেওয়া আর পুত্রবধূ প্রিয়াংকার চাকরি বন্ধ করে দেওয়া, এ দ্বৈতনীতির আড়ালে লুকিয়ে ছিল জমপতœীর মৃত্যু বীভৎস্য রূপ। যে জিঘাংসা পারিবারিক পীড়ন থামিয়ে দিল প্রিয়াংকার জীবন তরী। কিন্তু কেন এই জিঘাংসা।
প্রিয়াংকার মতো কত প্রাণ যে অকালে ঝরে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। তনু, রিশা, খাদিজা, নুসরাত, শাহিনুর আরও অজানা কতজন। এদের মর্মান্তিক মৃত্যুর পাশে যুক্ত হয়েছে সুনামগঞ্জের চিকিৎসক মেয়ে প্রিয়াংকার নাম। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসের অলিপুর এলাকায় একটি কালভার্টের পাশের জঙ্গল থেকে তনুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। ধর্ষণের পর সেখানে ফেলে রাখা হয় তনুর মৃতদেহ। তার বিচার কি পেয়েছে তনুর পরিবার। একই বছরের ২৪ আগস্ট রাজধানীর কাকরাইল ফুটওভার ব্রিজের ওপর দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে আহত রিশা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যায়। চৌদ্দ বছরের কিশোরী রিশার প্রেম প্রত্যাখ্যাত বখাটে ওবায়দুলের বিচার কি পেয়েছে সন্তানহারা পরিবার। ওই বছরের ৩ অক্টোবর সিলেটের এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে খাদিজা আক্তারকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে আহত করা বদরুলের যে বিচার হয়েছে তাকি পর্যাপ্ত? এখন সামনে নুসরাত, শাহিনুর, প্রিয়াংকা। এই অমানবিকতায় হয়তো আরও যোগ হবে কারো বোন, কারো মেয়ের নাম। সুনামগঞ্জের প্রিয়াংকা অঘটন প্রমাণ করলো পরিবারও নিরাপদ নয় মেয়েদের জন্য। তবে কি রাষ্ট্র, সমাজ এবং পরিবারের বাইরে গিয়ে বাঁচার পথ খোঁজতে হবে প্রিয়াংকাদের।
নীতিভ্রষ্ট কর্মকা-ের কুৎসিত রূপ প্রশ্নবিদ্ধ করছে সমাজবদ্ধ সামাজিক মানবকুলকে। মনের সুপ্ত মনুষ্যপনায় বারবার আঘাত করছে নানা অশুভ ভাবনা। নিরাশার অতল তলানিতে তলিয়ে যায় সুস্থ বোধশক্তি। নৈতিকতার পিঞ্জিরে আবদ্ধ লেখক মনোবৃত্তি প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া বারবার তুলে ধরছে দেশ ও দেশবাসীর সামনে। লেখক হিসেবে কলমের খালি ও ধবল কাগজখ- খরচ করাই যেন একমাত্র দায়িত্ব। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বরং দিন দিন বেড়েই চলছে অমানবিক অদূরদর্শিতা। কোনো সভ্য সমাজে এমন অনৈতিক অঘটন ঘটতে পারে না। যদি ক্ষুব্ধ মনের অতৃপ্ত ভাষাবোধ চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে, আমরা অসভ্য-অসহিষ্ণু সমাজে বসবাস করছি, তাহলে অত্যুক্তি হবে না। এ মনোভাবের বিপরীত প্রতিউত্তর কী হতে পারে? উত্তর একটাই বিচারহীনতা!
বিচারশূন্য রাষ্ট্রের অবস্থা যা হওয়ার তাই হচ্ছে। আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে যেভাবে নিষ্ঠুর-নির্মম ঘটনা ঘটে চলেছে, তার একটিরও কি সুষ্ঠু পরিণতি দেখেছে দেশবাসী। এখন পর্যন্ত কোনো অপরাধীর যথাযথ শাস্তি প্রয়োগের নিশ্চয়তা কি দিতে পেরেছে রাষ্ট্র! আমরা দেখছি দুষ্কৃতিকারী দুর্বৃত্তরা কীভাবে একের পর এক ধারাবাহিকতা বজায় রাখছে। যখন কোনো অঘটন ঘটে, তখন দু’চার দিন চলে দায়িত্বশীল মহড়া। প্রশাসন, রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে দেওয়া হয় সর্বোচ্চ বিচারের আশ্বাস। প্রিয়জন হারানো পরিবার-পরিজনের কাঁদতে কাঁদতে একসময় শুকিয়ে যায় চোখের নোনা জল। কিন্তু আশ্বাসের যেন কোনো নড়াচড়া নেই। এদিকে অপরাধী আইন-আদালতের গ-ি পেরিয়ে বীরদর্পে সেই পুরনো চেহারায়।
দেশে বিচারহীনতার এমন সংস্কৃতি যদি পেয়ে বসে সর্বত্র, তাহলে অপরাধীর অপরাধমাত্রা দ্বিগুণ হওয়াটাই স্বাভাবিক। সামাজিক অস্থিরতার ক্ষয়িষ্ণু রূপ বারবার উন্মোচিত হলেও রাষ্ট্রের সার্বিক অবস্থান থেকে যেন কিছুই করার নেই। তাহলে এভাবেই কি চলতে থাকবে! শ্বশুর বাড়ির লোকজনের অস্বাভাবিক আচরণের বলি হবে পুত্রবধূ, নিষ্পাপ-নিরপরাধ শিশু হবে জিঘাংসার শিকার, প্রেমের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেই নির্যাতন-হত্যা, কিশোরী-যুবতীদের ধরে ধরে ধর্ষণ শেষে মেরে মরদেহ ফেলে রাখা হবে যত্রতত্র। আজ অসংখ্য অপরাধে আড়ষ্ট আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা। এ অধঃপতনের অভীষ্ট লক্ষ্য বাস্তবায়নে নষ্টামির সবল বীজ বপন করছে এক বিচারহীন আজব দেশ। যেখানে নির্বিঘেœ অপরাধীরা উৎসাহ-উন্মাদনায় চালিয়ে যাচ্ছে তাদের সব নিষ্কর্ম, যার ধারাবাহিকতায় দেশবাসীকে দেখতে হলো ডা. প্রিয়াংকার নিথর দেহ।
[বিশ্বজিত রায়, সাংবাদিক ও কলামিস্ট, জামালগঞ্জ, সুনামগঞ্জ]