দু’টি হাইড্রোজেন ও একটি অক্সিজেন পরমাণু মিলে যেমন জলের সৃষ্টি তেমনি মানুষে মানুষে মিলে সমাজের সৃষ্টি। কারণ যৌথতা সমাজের নিয়ামক। এই অর্থে সমাজের মৌলিক উপাদান মানুষ। অর্থাৎ শেষমেষ প্রত্যেক মানুষই সমাজের সদস্য। তাই সমাজের শান্তি, শৃঙ্খলা, সংহতি, উন্নয়ন কিংবা বিকাশ ও সর্বাগ্রে এর সুরক্ষার যাবতীয় সব দায়িত্বভার প্রত্যেক সদস্যের জন্য অবিকল্প দায়। এই দায় এড়ানোর কোনও অবকাশ নেই কোনও মানুষের পক্ষেই। এই দায়মুক্ত মানুষ মানুষ নামের অবান্তর, এমন মানুষ সমাজের একক হবার অযোগ্য এবং তাকে কীছুতেই মানুষ বলা যাবে না।
গতকালের দৈনিক সুনামকণ্ঠের একটি সংবাদশিরোনাম ছিল, ‘সুরমা মার্কেট থেকে দুই ইয়াবা ব্যবসায়ী গ্রেফতার।’ এরপরে সংবাদের বিস্তারিত জানার আর কোনও দরকার আছে বলে মনে করি না। কারণ শিরোনাম থেকেই সরাসরি সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, এই দুই মানুষ সমাজের শান্তি, শৃঙ্খলা, সংহতি, উন্নয়ন কিংবা বিকাশ ও সর্বাগ্রে এর সুরক্ষার দায়িত্বভার পালন করছেন না। তারা সচেতনভাবে মানুষের জীবনবিনাশের বিনিময়ে টাকা উপার্জনের নিকৃষ্ট পথ অনুসরণ করছেন। ইয়াবা এমন একটি নেশাজাতীয় বস্তু যা শরীরে গ্রহণের ফলে গ্রহীতা মানুষ ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হয়ে শেষ পর্যন্ত অনিবার্যভাবে মৃত্যুবরণ করে। এটা মনে করার কোনও অবকাশ নেই যে, তাঁরা অর্থাৎ ইয়াবা ব্যবসায়ী দু’জনের কেউই ইয়াবা গ্রহণের ক্ষতিকর এবং আক্ষরিক অর্থেই মারাত্মক পরিণতির কথা জানেন না। অর্থাৎ ইয়াবা ব্যবসা চূড়ান্ত অর্থে মানববিধ্বংসী একটি অপরাধ, যা যে-কোনও বিবেচনায় ক্ষমার অযোগ্য। এই ইয়াবা ব্যবসাটি এমন একটি ব্যবসা, যে পণ্য মানুষকে মেরে ফেলবে সেটাকেই ক্রয় করতে বাধ্য করা হচ্ছে মানুষকে। এটা কোনও ব্যবসা হতে পারে না। যেমন ব্যবসা হতে পারে না, আদালত কর্তৃক বিক্রয় অযোগ্য ঘোষিত ৫২টি মানহীন পণ্য বিক্রয়। এগুলো এই জন্য মানহীন যে, হয় এগুলো ভেজালমিশ্রিত অথবা বিভিন্ন কারণেই খাওয়ার অযোগ্য। এইসব পণ্য বাজারজাত করে রাখা বা বাজার থেকে আদালতের নির্দেশ মতো বাজার থেকে প্রত্যাহার না করা প্রকৃতপক্ষে মানুষ খুন করার মতো জঘন্য অপরাধ। কারণ এইসব পণ্যের মানহীনতা কেবল মানহীনতা পর্যন্ত সীমিত নয়, এইসব মানহীন পণ্য মানুষের শরীরে দীর্ঘস্থায়ী ও সুদূরপ্রসারী পার্শ¦প্রতিক্রিয়া বজায় রাখে এবং শেষপর্যন্ত মানুষকে দুরারোগ্য ব্যাধিগ্রস্ত করে তুলে মৃত্যুমুখে পতিত করে। এই কারণে মানহীন পণ্য বাজারজাত করা ও বিক্রয় করা প্রকারান্তরে মানুষ খুন করার নামান্তর। এই ব্যবসা (মানহীন পণ্য বিক্রয়) জনস্থানে পরমাণু বোমা ফাটানোর অপরাধের চেয়ে কম কীছু নয়। অ্যাটম বোমা বিস্ফোরণে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাবে, জানা কথা, তেমনি মানহীন ও বিভিন্ন ব্যাধির আকর ৫২টি পণ্যকে অ্যাটম বোমা বিস্ফোরণের সমকক্ষ বলতে কোনও দ্বিধা থাকার কথা নয়, কারণ এই মানহীন পণ্য ব্যবহার করে প্রকৃত প্রস্তাবে দূর অথবা অদূরভবিষ্যতে লক্ষ লক্ষ মানুষ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে অনিবার্যভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হবেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সুতরাং সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠতে পারে যে, এই ইয়াবা বা মানহীন পণ্যের ব্যবসা আর অ্যাটম বিস্ফোরণে তফাৎ কোথায়? যে ক্ষেত্রে দু’টিই লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কারণ, তফাৎটা শুধু সময়ের পরিসরের, একটি (অ্যাটম বোমা) ধ্বংসযজ্ঞটি সাঙ্গ করে কয়েক মুহূর্তে ও অন্যটি (ভেজালমিশ্রিত মানহীন খাদ্য) বছরের পর বছর ধরেÑ ধীরগতিতে। আসলে কথা তো একটাই, লক্ষ লক্ষ মানুষ খুন। অর্থাৎ ভেজালমিশ্রিত খাদ্যও মূলত ধীরগতিতে কার্যকর একধরনের মারণাস্ত্র, অ্যাটমের মতোই অনিবার্য মৃত্যুদূত।
মুক্তবাজার অর্থনীতির মৌলিক নিয়ম মুনাফা অর্জন। এই মুনাফা অর্জনকে উপলক্ষ করে মানুষ খুন করাকে বাণিজ্য করে তুলেছে কতিপয় মানুষ। তারা ভুলে গেছে, মানবসমাজের স্বার্থেই ব্যবসাকে অবশ্যই মানবকল্যাণে ব্রতী করতে হবে। ইয়াবা কিংবা ভেজালমিশ্রিত খাদ্য বিক্রয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টজনকে ছাড় দেওয়া কোনও যুক্তিতেই সমীচীন নয়। সাধারণ মানুষ মনে করেন, খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে প্রভাবমুক্ত অবস্থায় কার্যকর করে তুলতে হবে এবং সরকারকে বার্নাড শো’র নাটকের ব্যবসায়ী চরিত্র ল্যাজারাসমুক্ত থাকতে হবে। নাটকে বার্নাড শো দেখিয়েছেন, ল্যাজারাস ও তাঁর বন্ধু দুই ব্যবসায়ী, যারা সরকারকে কার্যত নিয়ন্ত্রণ করে এবং ল্যাজারাসের বন্ধুর সাংসদ পুত্র সংসদে পুতুলের ভূমিকা পালন করে ল্যাজারাস ও তার বন্ধুর মনোমতো কাজ করে দেয়। আসলে প্রভাবমুক্ত হয়ে রাষ্ট্রের নাগরিকদের জীবন রক্ষায় ব্রতী হতে হবে। অন্যথায় ভেজালমিশ্রিত খাবার খেয়ে ও ইয়াবা গ্রহণ করে সমগ্র জাতিকে ধীরগতিতে কার্যকর ব্যবসা নামের অ্যাটম বোমার বিস্ফোরণে মৃত্যুমুখে পতিত হবার অপেক্ষায় থাকতে হবে।