নদীমাতৃক বাংলাদেশে মানুষের সাথে নদীর সম্পর্ক চিরকালের। মানুষের জীবন-জীবিকা ও সভ্যতার অগ্রগতিও ঘটেছে নদীর তীরে। দেশের প্রায় শহর, নগর, বাণিজ্য কেন্দ্র নদীর তীরে গড়ে ওঠেছে। তাই বাংলাদেশের মানুষের সাথেও নদীর স¤পর্ক নাড়ির। আর এই নদীমাতৃক দেশে ছোট-বড় ২৩০টি নদ-নদী রয়েছে যার সাথে দেশের অধিবাসীদের জীবনযাত্রা এসব নদ-নদীর প্রভাব অত্যন্ত ব্যাপক। তাই জীবন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে এসব নদ-নদীর ভূমিকা অপরিসীম। বাংলাদেশের যেসব এলাকায় সড়ক ও রেলপথ নেই, সেসব অঞ্চলে নদীপথই যোগাযোগ ও পরিবহনের একমাত্র মাধ্যম। কিন্তু বর্তমানে মানুষ, প্রকৃতির আচরণ নদীগুলোর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে দেশের ২৩০টি নদ-নদীর বেশির ভাগই আজ মৃত-অর্ধমৃত প্রায়। গত অর্ধশতাব্দী আগেও দেশে বর্তমানের দ্বিগুণ নদী ছিল। এ তথ্য এটাই প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে নদী বাঁচানো কতটা অপরিহার্য।
বাংলাদেশে জমি ও চর দখলের পাশাপাশি নদী দখলও চলছে ব্যাপক হারে। সুরমা, কর্ণফুলী, কীর্তনখোলা, করতোয়া, রূপসাসহ দেশের আরো ৭০টি শহরসংলগ্ন ছোট-বড় নদী দখল হয়ে গেছে। তথ্যানুসারে ২ লাখ ভূমিদস্যু দেশের বিভিন্ন নদ-নদীর বিরাট অংশ দখল করে বাংলাদেশ আজ নদীশূন্য মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তবে বর্তমান সরকারের উদ্যোগে নদী উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে সফলতাও অর্জন হয়েছে। যা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।
নদী শুধু দখলই নয়, দূষণেরও শিকার। দেশের বেশির ভাগ নদীদূষণের কবলে পড়েছে। কৃষি জমিতে প্রচুর রাসায়নিক সার প্রয়োগ হচ্ছে, যা বৃষ্টি ও বন্যার পানিতে মিশে নদীতে গিয়ে পড়ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শুধু ১৯৮০-৮১ অর্থবছরেই ২৬ লাখ টন রাসায়নিক সার ব্যবহৃত হয়েছে।
বর্তমানে এর পরিমাণ ৩০ লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। পরিসংখ্যানের সূত্র মতে, অপরিকল্পিত পয়োনিষ্কাশন, নদীর পাশের বিভিন্ন শিল্প ইউনিট ও ট্যানারির বর্জ্য নদীর পানিকে দূষিত করছে। গ্রামাঞ্চলের নদীগুলোর পরিণতিও ক্রমে ক্রমে একই দিকে যাচ্ছে। পরিবেশ অধিদফতর ১৭টি নদীর ৩৮টি স্থানের পানি পরীক্ষা করে দেখেছে, এসব নদীর পানি দূষিত ও ব্যবহারের অযোগ্য। নদীদূষণের কারণে পানিতে অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, কার্বন, নিকেল, সিলিকনসহ ১৬-২০টি উপাদান হ্রাস পাচ্ছে, যা নদীতে জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণির বেঁচে থাকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসব উপাদানের অভাবে নদীর বহু প্রজাতির মাছ ও জলজ উদ্ভিদ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
এ অবস্থায় নদীমাতৃক বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে দীর্ঘমেয়াদিভাবে নদীভিত্তিক সমস্যার সমাধান করা জরুরি। এ দেশের বেশির ভাগ মানুষের জীবন, জীবিকা ও সার্বিক উন্নতি নির্ভর করে নদীর ওপর। আমাদের মনে রাখতে হবে- দেশের নদী বাঁচলে, মানুষ বাঁচবে।