গতকালের দৈনিক সুনামকণ্ঠের শীর্ষসংবাদ প্রতিবেদন ছিল নববর্ষ বরণের বর্ণাঢ্য আয়োজনের বিষদ বর্ণনায় সমৃদ্ধ। বর্ণনার শুরুটা এরকম, ‘বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা, বৈশাখী গান, পান্তা উৎসব, লাঠিখেলাসহ নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নেয়া হয়েছে। এসব কর্মসূচিতে নানা বয়সের মানুষের ঢল নামে। অংশগ্রহণকারীরা অসাম্প্রদায়িক দেশ ও সোনার মানুষ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।’ আর অন্যদিকে ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমগ্র দেশবাসীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধভাবে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য কাজ করে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।’
‘সোনার বাংলা কিংবা সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয়টি একটি রাজনীতিক স্বপ্ন। স্বপ্ন মানুষই দেখে। মানুষের চেয়ে তার স্বপ্ন বড় না হলে মানুষ কখনওই বড় হতে পারে না, হতে পারে না মহৎ। মানুষ নিজেকে অতিক্রম করে তার স্বপ্নের বিগ্রহ বিনির্মাণে চরিতার্থ হয়ে। অনেকে বলে থাকেন সোনার বাংলা বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠিত একটি রাজনীতিক মিথ। যে-মিথের বশবর্তী হয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি…’ গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত করে দিয়েছেন। নববর্ষের উৎসবের খবর পরিবেশন করতে গিয়ে পত্রিকায় যখন লেখা হয়, ‘এসব কর্মসূচিতে নানা বয়সের মানুষের ঢল নামে। অংশগ্রহণকারীরা অসাম্প্রদায়িক দেশ ও সোনার মানুষ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।’ তখন ‘সোনার বাংলার’ মতো আর একটি রাজনীতিক মিথ ‘সোনার মানুষ’-তৈরির প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। বিষয়টি সার্বিক বিবেচনায় অন্যরকম।
লোকে সোনার হরিণ চায়। এর একটি তাৎপর্য আছে। তাৎপর্য এই যে, অর্থনীতি মানুষের জীবনের চালিকা শক্তি। মানুষ সর্বাগ্রে একটি আর্থনীতিক জীব। এখন লোকে সোনার মানুষ চাইছে। সোনার মানুষ চাইলে সোনার হরিণকে চাওয়া হয়ে যায় এমনিতেই। সোনার হরিণের প্রাপ্তি ভিন্ন সোনার মানুষের অস্তিত্ব কল্পনাতীত। মানুষের হাতে সোনার হরিণ চাই অর্থাৎ অর্থ চাই। কপর্দকশূন্য মানুষ মানুষ নামের অবান্তর। অন্তত পুঁজিবাদী আর্থব্যবস্থা বরাবর তাই প্রতিপন্ন করে। এটা প্রতিপন্ন করতে গিয়ে ধনীরাও সোনার মানুষ হয়ে উঠতে পারে না, তারা কেবল ধনীই হয়। বিল গেটস দিনে আট কোটি ডলার ব্যয় করলেও তাঁর টাকা ফুরাতে নাকি লাগবে আড়াই শত বছর। শুনেই মনে হয় একজনের হাতে সম্পদের এই পাহাড় একটা অর্থহীন ব্যাপার, এমনটা হওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। সোনার মানুষ চাইলে সকল মানুষের মাথাপিছু আয়ের স্ফীতি অবশ্যই চাই কিন্তু কেবল একজনের আয়ের এমন বিরাট স্ফীতি চাই না। সম্পদের আঢ্যতা ভিন্ন সোনার মানুষের কল্পনা সোনার পাথর বাটি ভিন্ন অন্য কীছু নয়। কিন্তু বাংলাদেশে উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বৈষম্য। এমন হলে দারিদ্র্য বাড়বে বৈ কমবে না। দারিদ্র্য নামক প্রপঞ্চটি সোনার মানুষ গড়ার প্রত্যয়ের প্রথম ও সর্বশেষ প্রতিবন্ধক।
আমরাও সোনার মানুষ চাই। সোনার বাংলায় তো সোনার মানুষই থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। মানুষকে সোনার মানুষ করে তোলতে হলে মানুষের হাতে প্রচুর সম্পদ তোলে দিতে হবে। সে সম্পদ প্রাপ্তিতে সমতার একটা নিরিখ থাকতে হবে। সমাজে সম্পদের অসমবণ্টন প্রতিষ্ঠিত রেখে কিংবা মানুষকে ধনী ও গরিব বানানোর মুক্তবাজার বহাল রেখে সোনার মানুষ তৈরি কখনওই সম্ভব নয়। সোনার মানুষ গড়তে হলে আগে ধনীগরিব সৃষ্টির সমাজব্যবস্থাকে ভাঙতে হবে। গড়তে হবে নতুন সমাজ। তবেই না তৈরি হবে সোনার মানুষ। আসল কথা, সোনার মানুষ তৈরি করতে হলে আগে সোনার বাংলা তৈরি করা চাই।