1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:০৬ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

বাংলার মেলা পর্ব এবং হাওরপাড়ের নববর্ষ : সুখেন্দু সেন

  • আপডেট সময় রবিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৯

বারো মাসে তেরো পার্বণের লোকজ সংস্কৃতির বিচিত্র রঙে, রূপে ভরপুর গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের এ পলিল ভূখ-। বাঙালি জীবনধারার সাথে মেলা পার্বণের যোগসূত্র দীর্ঘদিনের। এ স¤পর্ক আত্মিক ও নিবিড়। লোকজীবন ও লোকসংস্কৃতির সমন্বিত পরিচয় মেলাতেই সার্থকভাবে প্রকাশিত এবং প্রতিফলিত। রবীন্দ্রনাথের ভাবনা থেকে ধার করে যদি বলি তবে বিষয়টি এভাবে উপস্থাপন করা যায়Ñ পল্লী প্রধান এই দেশে পল্লী যখন মাঝে মাঝে আপনার বাড়ির মধ্যে বৃহৎ জগতের রক্ত চলাচল অনুভব করার জন্য উৎসুক হয়ে উঠে তখন মেলাই তার প্রধান উপায়। এ মেলা আমাদের দেশে বাহিরকে ঘরের মধ্যে আহ্বান জানায়। এমন উৎসবে পল্লী আপনার সংকীর্ণতা বিস্মৃত হয়। হৃদয় খুলে দান করা আর গ্রহণ করার উপলক্ষ খুঁজে।
বাংলাদেশে মেলা পর্বের ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। এর প্রাচীনত্বের সীমা নির্দিষ্টকরণ সম্ভব নয়। তবে এটা নিশ্চিত পল্লীর নিবিড় অন্তর থেকেই মেলার উদ্ভব। ধারণা করা হয় যে ধর্মীয় উপলক্ষ থেকেই মেলার জন্ম। পরে এর সাথে যুক্ত হয় নানা অনুষঙ্গ। স্থানীয় বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্য ধারণ করে পায় সার্বজনীন রূপ।
মেলা বলতেই উৎসব। বাঙালির উৎসবপ্রিয়তা সর্বজনবিদিত। যে কোন উপলক্ষকেই তারা উৎসবে রূপান্তরিত করে নিতে পারে। গ্রামীণ শ্রমনিবিড় দৈন্যদগ্ধ জীবনও কোন না কোনভাবে যুক্ত হয়ে যায় মেলার উদার সামাজিক বৈশিষ্ট্যে। যদিও ভিন্নতা থাকতে পারে আবেগ-অনুভূতিতে।
বাংলাদেশে যত মেলা পার্বণের আয়োজন তার নব্বই ভাগই গ্রামীণ মেলা। সারা বছরই দেশের কোন না কোন স্থানে নানা উপলক্ষে মেলা বসে বিভিন্ন স্থায়ীত্ব নিয়ে। তবে উৎসব আবহ সমানভাবেই পরিলক্ষিত হয়।
ধর্মাশ্রিত মেলাগুলির অন্তরঙ্গে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান থাকলেও বহিরঙ্গ হয়ে উঠে ধর্মনিরপেক্ষ আর্থ-সাংস্কৃতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও পরিচালিত। রথের মেলা, বারুনীর মেলা, সোমেশ্বরীর মেলা, ¯œানযাত্রা, দোলযাত্রার মেলা, ভোলাভুলির মেলা, পৌষ সংক্রান্তি – চৈত্র সংক্রান্তির মেলাও তেমনি ধর্মীয় আবরণের বাইরে এসে হয়ে ওঠে উৎসব, বিনোদন, কেনাকাটা সামাজিক মেলবন্ধনের উদার ক্ষেত্র। এছাড়া সাধু-সন্ত, পীর-দরবেশদের সাধনপীঠ, মাজার, সমাধিতে আবির্ভাব-তিরোধান তিথিকে কেন্দ্র করে ওরস এবং সে উপলক্ষে মেলাও বসে। এসব মেলা জাতিধর্ম নির্বিশেষে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
পূর্ব উদ্ধৃত রবীন্দ্রভাবনার শত বৎসর পরে বাংলাদেশে বর্ষবরণ বা বৈশাখী মেলা ভিন্ন চিন্তা চেতনায় ভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে বাঙালি সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যোগ করেছে অনন্য মাত্রা। চিরায়ত গ্রামীণ লোকজ সংস্কৃতির নগরায়ন ঘটিয়েছে এ মেলা। নাগরিক জীবন এবং গ্রামীণ জীবনের মেলবন্ধনই বৈশাখী
মেলার বৈশিষ্ট্য। পহেলা বৈশাখ হালখাতা অনুষ্ঠানের গ-ি পেরিয়ে মেলা বা উৎসবে রূপান্তর বঙ্গ সংস্কৃতির সাম্প্রতিক সংযোজন। বর্ষবরণের উৎপত্তিস্থল ঢাকার রমনার বটমূল গ্রামের বট-পাকুড়াশ্রিত চত্বরে আয়োজিত মেলার প্রতীক। বটমূলের আয়োজন থেকে পরবর্তীকালে তা ছড়িয়ে যায়, চারুকলা, টিএসসি, ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবর, হাতির ঝিল, শাহবাগসহ বিভিন্ন কেন্দ্রে। ঢাকা থেকে ক্রমে জেলাশহর, উপজেলা শহরে। বর্ষবরণ বা বৈশাখী উৎসব লোকজ উপজীব্য নিয়ে শহরে দাপট দেখালেও গ্রামীণ প্রান্তিক জনমানসে এর আবেদন এখনও তেমন প্রবল হতে পারেনি।
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর সংস্কৃতি লোকাচারের সাথে বাংলা সন ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রচলনই হয়েছে মূলত কৃষিকাজ ও খাজনা সংগ্রহের ব্যবস্থাকে ঘিরে। জমিতে চাষ দেয়া, বীজবোনা, ফসলতোলা, খাজনা দেয়া, সামাজিক ক্রিয়াকর্ম, জন্মমৃত্যু, বিয়ে-শাদি বাংলা সন তারিখ নির্ভর। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে গ্রামীণ জীবনযাত্রায় বাংলা সন তারিখের দীর্ঘ প্রচলন থাকলেও গ্রামীণ সংস্কৃতিতে হালখাতা ব্যতীত বর্ষবরণ বা নববর্ষের কোনো অনুষ্ঠান নিকট অতীতেও লক্ষ করা যায়নি। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে বাঙালির অনিরুদ্ধ আবেগ সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় শেকড় সন্ধানী সৃষ্টিশীল বিকাশ সম্ভব করে তুলেছে। মেলা পার্বণের এই দেশে ঐতিহ্য আনুগত্যে স্থানীয় মেলা বা উৎসব নতুন পরিসরে যুক্ত হয়ে বঙ্গ সংস্কৃতির পরিধি বিস্তৃত করে চলছে। পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ উদযাপন মূলত লোকজ ঐতিহ্যের নাগরিক আগ্রহ থেকেই সৃষ্ট। শহুরে জীবনে এর আবেদনটা বেশি। পহেলা বৈশাখ নাগরিক মনে ক্ষণিকের জন্য হলেও গ্রাম তৃষ্ণা জাগিয়ে তুলে। শেকড়ের টান অনুভূত হয় শহরদগ্ধ জীবনে। গ্রাম্য জীবনে তেমনটি অনুভূত হয় না।
ভৌগোলিক বৈচিত্রের কারণে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লোকাচার ও জীবনযাত্রারও তারতম্য রয়েছে। অফুরন্ত কৃষি ও জলজ স¤পদে ভরপুর হাওর অঞ্চলে ছয় মাস শুষ্ক এবং ছয় মাস জলাশ্রয়ী জীবনধারা স্বাভাবিকভাবেই দেশের অন্য অঞ্চল থেকে ভিন্ন। এখানে বৈশাখ বর্ষবরণের আনন্দ নিয়ে আসে না, আসে ফসল তোলার সংগ্রামী আহ্বান নিয়ে। বৈশাখের রুদ্ররূপ আর বিধ্বংসী চরিত্রকে বরণ করতেই তারা অভ্যস্ত। প্রাকৃতিক স্বেচ্ছাচারিতা ও খামখেয়ালিপনার বিরুদ্ধে লড়াই করেই হাওরপাড়ের মানুষ বেঁচে থাকে। কখনও প্রকৃতির উদার সহনীয় আচরণে স্বস্তি বোধ করে, গোলায় ফসল তুলে তৃপ্তি পায় কিন্তু ফুসরত পায় না রঙে ভরা বৈশাখের রঙ উপভোগের। হাওরজুড়ে তখন অন্য উৎসব। সে এক মহাসংগ্রাম। হাওর তখন এক রণাঙ্গন। ফসল কাটা, মাড়াই, শুকানোর মহাযজ্ঞ। তার রূপ রঙ ভিন্ন। আর যে বছর অতিবৃষ্টি শিলাবৃষ্টি, ঢল প্লাবনে নদীর জল ফুলে-ফেঁপে ওঠে হাওরে ঢোকার ফাঁক-ফোকর খুঁজতে থাকে, ফসল রক্ষার ঠুনকো বাঁধ যখন কোন প্রতিরোধ ছাড়াই বালির বাঁধের মত ভেসে যায়- শ্রম, ঘাম, যতœ পরিচর্যায় সন্তান ¯েœহে ফলানো কাঁচা-পাকা ধানও তখন চোখের সামনে তলিয়ে যায়। সেই সাথে তলিয়ে যায় কৃষকের স্বপ্ন। সে নতুন বছর শুরুই হয় তাদের হতাশা আর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে। যেমনটি হয়েছিল ১৪২৪ বঙ্গাব্দের বৈশাখে। বর্ষবরণের শহুরে উচ্ছ্বাস চাপা পড়ে গিয়েছিল ফসলহারা মানুষের হাহাকারে। শুধু প্রকৃতির খামখেয়ালিপনাই নয় হাওর রক্ষায় নিয়োজিত দের লোভ, দুর্নীতি, খামখেয়ালিপনার কাছেও পরাজিত হয় প্রকৃতির যোদ্ধা কৃষক।
বৃটিশ যুগ পাকিস্তান যুগ গেছে আগেই। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালনের প্রস্তুতি চলছে কিন্তু লুটেরা বর্গীরা এখনও সক্রিয় রয়ে গেছে বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন ক্ষেত্রে রক্ত দিয়ে অর্জিত এই স্বাধীন দেশে। আর উদার হাওর হয়ে উঠেছে নব্যবর্গীদের অবাধ লুণ্ঠনের অবারিত ক্ষেত্র। বৈশাখের কালো মেঘের মতই হাওরপাড়ের কৃষকের মনে নিত্য শঙ্কা ও দুশ্চিন্তার জমাট বাঁধা মেঘ। অনিরাপদ বাঁধ আর প্রকৃতির ব্যতিক্রমী আচরণ কৃষকের মনে স্বস্তি দিতে পারে না সারা বৈশাখ জুড়েই। বর্ষবরণের সে অবকাশ আর থাকে কোথায়। তখন শুধুই সংগ্রামের প্রস্তুতি, ফসল আগলে রাখার তাগিদ। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে প্রকৃতির দাক্ষিণ্যে ফসল গোলায় তুলে স্বস্তি আর নয়তো কৃষকের চোখে বৈশাখের একটি মাত্র রঙ। সেটি অন্ধকার।
বর্ষবরণের আয়োজন শহরে প্রাণ পেলেও মূলত বাংলা নববর্ষের ভিত্তি গড়ে দিয়েছে কৃষক। যারা মাটিতে প্রাণ ফোটায়। সারা বছর যারা সবুজের সাধনা করে। বৈশাখে সে রঙ সোনালী হলে তাদের বুক ভরে। ধানপাকা সোনালী রঙই বৈশাখী উৎসবের প্রকৃত রঙ। হাওরে হাওরে লাগুক সোনালী বৈশাখের রঙ। সে রঙ যেন কোনদিনই কালো না হয় জাগুক সে প্রত্যয়।
পহেলা বৈশাখ চিরন্তন। বৈশাখের রুদ্র রূপ সংগ্রামী চেতনার প্রতীক। বর্ষবরণের অনুষ্ঠান সেতো প্রতিবাদ প্রতিরোধের দীপ্ত প্রত্যয়ে সংহত। হাওরপাড়ের বর্ষবরণে থাকুক ফসল তোলায় নিয়োজিত সংগ্রামী যোদ্ধাদের প্রতি সংহতি। লুটেরা মুক্ত হোক হাওর। নিরাপদ থাক ফসল। ফসল রক্ষার অধিকার নিশ্চিত হোক।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com