1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৩৬ অপরাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

প্রাথমিক শিক্ষা ও আমাদের করণীয় : নাসরীন আক্তার খানম

  • আপডেট সময় বুধবার, ২০ মার্চ, ২০১৯

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে এনে দিয়েছিলেন মুক্তির বারতা, অকুতোভয়ে বজ্রকণ্ঠে ডাক দিয়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার। এরই ফলশ্রুতিতে আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। জাতির জনকের প্রতি জানাই বিন¤্র শ্রদ্ধা।
একটি দেশকে গড়তে হলে সবার আগে দেশবাসীকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে হবে এই বিষয়টি বঙ্গবন্ধুর চিন্তায় ও মননে সর্বদাই ছিল। শিক্ষা মানুষের আচরণগত দিকে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন ঘটিয়ে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটায়। শিক্ষা মানুষের ভেতর সংস্কৃতির উন্মেষ ঘটাবে, চেতনার জগতে ব্যাপক পরিবর্তন এনে তাকে মানবধর্মে উদ্বুদ্ধ করবে এবং তার জাগতিক প্রয়োজন মেটাবে Ñ সে ধরনের একটি শিক্ষা ব্যবস্থা বিনির্মাণের যাঁরা ধারক, তাঁদের সাথে জাতির জনকের নামও অনায়াসে যুক্ত করা যায়।
স্বাধীনতা অর্জনের পর পরই শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নেন বঙ্গবন্ধু। এরই ধারাবাহিকতায় ডা. কুদরত এ খুদা শিক্ষা কমিশন তিনি গঠন করেছিলেন। জাতীয়করণ করেছিলেন প্রাথমিক স্কুলগুলোকে। এর ফলে শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়ে যায়। শিক্ষা পৌঁছে যায় সকলের দোরগোড়ায় এবং প্রাথমিক শিক্ষকগণেরও আর্থিক দৈন্যদশার উন্নয়ন ঘটে।
২০১৩ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে জাতীয়করণ করেন। গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনা প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে আরও অনেক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেন। তার মধ্যে সবার জন্য উপবৃত্তি চালু, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা চালু, ডিজিটাল শিক্ষা ব্যবস্থা চালুসহ আরও অনেক অনেক পদক্ষেপ। প্রাথমিক স্কুলের শিশুদের জন্য বঙ্গবন্ধু বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট, আন্তঃপ্রাথমিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন শিশুদের মনোদৈহিক বিকাশের ক্ষেত্রে রাখছে যুগান্তকারী ভূমিকা, যা নিঃসন্দেহে ইতিহাসে স্মরণীয় বরণীয় হয়ে থাকবে। বছরের প্রথম দিনে নতুন বইয়ের গন্ধ, কেবল প্রাথমিকের জন্য প্রাথমিক শিক্ষাপদক চালু অসামান্য গৌরবজনক সংযোজন।
আমাদের আজকের প্রবন্ধের বিষয় প্রাথমিক শিক্ষা ও আমাদের করণীয়। এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে বলতে হয়- শিক্ষা জীবনভর চলমান একটি প্রক্রিয়া, শিক্ষার কোনও শেষ নেই।যদিও পদ্ধতিগত, কাঠামোবদ্ধ শিক্ষার সময় ও সিলেবাস নির্ধারিত এবং আমরা এই পদ্ধতিগত শিক্ষার কথাই বলছি। তাহলে এই শিক্ষার সাথে প্রাথমিক শব্দটি যুক্ত করে একে বিশেষায়িত কেন করা হলো? করা হয়েছে এজন্য যে প্রাথমিক শিক্ষা হলো উচ্চ ও উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থার মূল ভিত্তি স্বরূপ। শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষার কাক্সিক্ষত প্রান্তিক যোগ্যতা সমূহ শতভাগ অর্জন করে সুশিক্ষিত ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে, বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্বের কাতারে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াস পাবে এবং যোগ্য নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে। উচ্চশিক্ষা অর্জনের, বিশাল পৃথিবীর বিশাল মঞ্চে যে কর্মযজ্ঞ তাতে প্রথম পা ফেলার প্রথম পদক্ষেপ হলো প্রাথমিক শিক্ষা, বিশাল পৃথিবীতে নিজেকে প্রতিযোগিতায় সফল করা, টিকে থাকা তারই প্রস্তুতি হলো প্রাথমিক শিক্ষা এবং এর গুরুত্ব অপরিসীম।
একটি ক্ষুদ্র চারাগাছ মহীরূহতে পরিণত হবে কিনা, চারা অবস্থায় তা বীজ, মাটি, আবহাওয়া ও যতেœর উপর নির্ভর করে, তেমনি মানবশিশুর বেলায়ও তাই। শিক্ষাবান্ধব অনুকূল একটি প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা একটি শিশুর মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারে। সেই লক্ষ্যে আমাদের শিক্ষাবান্ধব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সেই সাথে প্রাথমিকের বিশাল যে জনবল কাঠামো কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত – সবাই আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনের জন্য।
কিন্তু তারপরও দেখা যাচ্ছে আমরা ইপ্সিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছি।
* শতভাগ ভর্তি : শতভাগ ভর্তি নিশ্চিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। যদিও সুনামগঞ্জ জাতীয় অর্জন থেকে পিছিয়ে,এর হার ৯৪% প্রায়। কিন্তু স্কুলগুলোতে শিক্ষক শিক্ষার্থী অনুপাত যেখানে জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী ১:৩০ হওয়ার কথা, সেখানে সর্বত্র এই অনুপাত বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছেনা। হাওর জেলা সুনামগঞ্জে এই অনুপাত ১:৫৫।
সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী শিক্ষক শিক্ষার্থী অনুপাতে পিছিয়ে থাকা জেলাগুলোর মধ্যে সুনামগঞ্জের অবস্থান দ্বিতীয়। সদ্য জাতীয়করণকৃত স্কুলসমূহে এটি আরও বেশি।
* উদ্বেগজনক তথ্য হচ্ছে দেশের সাড়ে ছয়শো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৫০ এর নিচে নেমে এসেছে, ২৫টি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ২০ জনের কম।
বলা হয়ে থাকে এজন্য সংশ্লিষ্ট স্কুলশিক্ষকগণ দায়ী । আমাদের বাস্তব পরিপ্রেক্ষিত বিচার করতে হবে। একটি দেশে সকল শিক্ষার্থীর জন্য কেন একই ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু থাকবেনা?
কোনও গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা সরকারি প্রাথমিক স্কুলে তাঁদের সন্তান পড়াতে চান না, কারণ প্রাথমিক স্কুলগুলোতে সকল শ্রেণির শিশুরা পড়ার সুযোগ পায়।
যদি সকল শ্রেণির কর্মকর্তা ও উচ্চবিত্ত গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকদের সন্তানেরা সরকারি প্রাথমিক স্কুলে পড়তো তবে প্রাথমিক স্কুলসমূহ তত্ত্বাবধান, বিরাজিত সমস্যাসমূহ চিহ্নিতকরণ ও এর সমাধান অধিকতর সহজ হতো বলে আমি মনে করি। আভিজাত্যবোধ,স্বাতন্ত্রময়তা ধরে রাখার মনোভাব, শিক্ষকদের অতিরিক্ত পাঠদান বহির্ভূত কাজের চাপ প্রাথমিকে ভর্তির ব্যাপারে অনীহার কারণ হিসেবে এক্ষেত্রে দায়ী বলে মনে করা হয়। এতে শিশুরা বৈষম্যের মাঝে বেড়ে উঠে। অথচ প্রাথমিক শিক্ষকবৃন্দই সবচে বেশি দক্ষ এবং যোগ্যতা স¤পন্ন।
দীর্ঘ স্কুল টাইম, টিফিন টাইমের স্বল্পতাও প্রাথমিকে ভর্তি করতে অনীহার আরেকটি কারণ বলে মনে করেন অনেকে। আবার অনেক অভিভাবক চান তার শিশু অধিক বই পড়–ক যা সরকারি প্রাথমিকে নেই। স্কুলের ব্যাগে বইয়ের চাপে পিষ্ট হয় অজানতে অনেক শিশুর শৈশব- আর প্রাথমিক স্কুলের অনেক শিশু পর্যাপ্ত খাতা-কলমও কিনতে পারেনা অনেক সময়।
* প্রাথমিক স্কুলে দরিদ্র পরিবারের শিশুরা আসে, তাদেরকে অনেক সময় পরিবারের কাজে সাহায্য করতে হয়। উপবৃত্তি মাসে একশত টাকা শর্তপূরণ সাপেক্ষে, অনিয়মিত উপস্থিতির কারণে তারা সেই শর্তগুলো পূরণে প্রায়ই ব্যর্থ হয়।
বাবাকে কাজে সাহায্য করলে বা মায়ের অবর্তমানে ঘরের কাজে সাহায্য করলে এরচেয়ে অধিক টাকা তাদের পরিবার একদিনেই রুজি করতে পারে। এজন্য স্কুলে উপস্থিতি কম হয়।
* অনেক পরিবারে সকালের খাবারের সংস্থান থাকেনা, ফলে তারা না খেয়ে এবং দুপুরের খাবার না নিয়েই স্কুলে চলে আসে, বিরতির পর এরা স্কুল পালায়। আকর্ষণীয় বিদ্যালয় ভবন এর কাছে পেটের খিদে হার মানে।
তারপরও শিক্ষকদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় অনেক অভিভাবক সন্তানের খাবারটি রান্না হওয়ার পর স্কুলে এসে দিয়ে যান।
স্কুলের দীর্ঘসময় কোমলমতি শিশুদের কাছে ক্লান্তিকর মনে হয়, অনেকসময় অনেক শিশু শ্রেণিকক্ষে ঘুমিয়ে পড়ে। তারা পায়না পর্যাপ্ত খেলার সুযোগ।
অনেক সময় দেখা যায় পার্শ্ববর্তী হাইস্কুল ছুটি হয়ে যায় তাদের বিরতির সময়ে তখন তারা হতাশ চোখে বড়দের বাড়ি যাওয়া দেখে।
প্রতিটি উৎসবে তারা হাইস্কুল, কলেজ বা ভিন্ন ক্যাটাগরির প্রাথমিক স্কুল থেকে ছুটি কম পায়। গ্রীষ্মের বন্ধেও তাদের ছুটিটাই কম থাকে। অথচ এসব কোমলমতি শিশুদেরই ছুটির বেশি প্রয়োজন, খেলাধুলার সুযোগটা বেশি থাকা প্রয়োজন।
* সুনামগঞ্জ একটি হাওর বেষ্টিত এলাকা। কথায় আছে হেমন্তে পাও, বর্ষায় নাও। প্রাকৃতিক কারণেই স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থী উপস্থিতি কম থাকে। বর্ষায় হাওর পাড়ি দিয়ে স্কুলে যাওয়া অনেক সময় বিপজ্জনক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের জন্যই। এজন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার আশু উন্নয়নের পাশাপাশি প্রয়োজন হাওর এলাকার জন্য আলাদা ভাবে গৃহীত সুচিন্তিত পরিকল্পনা।
* বিভিন্ন আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগও মানসম্মত শিক্ষা অর্জনে প্রভাব ফেলে। অকাল বন্যায় ফসলহানি, কর্মের অভাবে অভিভাবকগণ জীবিকার সন্ধানে অন্যত্র গমন করেন। এর প্রভাব সমাপনী পরীক্ষায়ও প্রভাব ফেলে। ২০১৮ সালে সমাপনীতে সুনামগঞ্জ জেলার পাসের হার ছিল ৯২.৯১%।
তুলনায় উন্নত ছাতকে এই হার ৯৭%। শাল্লায় সবচে কম ৭৯.৩%।
* মাঠপর্যায়ে যারা প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের গুরুদায়িত্ব পালন করেন, উচ্চ পর্যায়ে গৃহীত বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় তাদের মতামত নেয়া ও গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা জরুরি। কারণ মাঠপর্যায় স¤পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাগণ এবং বিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকবৃন্দ।
* শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক এই তিনের সমন্বয় ব্যতীত কোনও কর্মসূচিই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এজন্য অভিভাবকদের জন্য শুধু হোম ভিজিট, মা/অভিভাবক সমাবেশ, উঠান বৈঠকই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন শিক্ষার গুরুত্ব বুঝানোর জন্য তাদের নিয়ে মাঝে মাঝে শিক্ষামূলক সেমিনার, সভা, কর্মশালার আয়োজন করা।
* সুনামগঞ্জ যেহেতু ভৌগোলিকভাবে একটি দুর্গম ও হাওরবেষ্টিত এলাকা, এজন্য এই জেলার জন্য পৃথক কোনও পরিকল্পনা নেয়া যায় কিনা তা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে।
* আমরা প্রাথমিক শিক্ষা পরিবার, শত বাধার মুখেও সরকার কর্তৃক গৃহীত প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়ন সংক্রান্ত যে কোনও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বদ্ধ পরিকর।
* প্রাথমিক স্তর যেহেতু শিশুর ভিত তৈরির স্তর – কাজেই শিক্ষক শিক্ষার্থীর নিবিড় স¤পর্ক, এবং সেই সাথে নিবিড় সাহচর্য্য প্রয়োজন। কোনও অবস্থায়ই এর ব্যত্যয় ঘটানো কাক্সিক্ষত ফল বয়ে আনবেনা। কাজেই শিক্ষকগণ অবশ্যই শ্রেণিকক্ষে অবস্থান করবেন এবং আনুষঙ্গিক কাজের জন্য প্রতিটি বিদ্যালয়ে একজন করে অফিস সহকারী নিয়োগ জরুরি। সেই সাথে আমি শিক্ষকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য বিনীত আহ্বান জানাই।
[নাসরীন আক্তার খানম : প্রধান শিক্ষক, শহর বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সুনামগঞ্জ]

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com