1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:৪৬ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

ইতিহাস ডাক দিয়ে যায় যে অমর কবিতায় : সুখেন্দু সেন

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ৭ মার্চ, ২০১৯

সহস্র বৎসরাধিক কাল ধরে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের ঐতিহ্যম-িত ভৌগোলিক সীমানায় সংহত নরগোষ্ঠী বাঙালি অভিধায় অভিহিত হলেও বাঙালি জাতিত্ববোধের ধারণা খুব প্রাচীন নয়। জাতিয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে সংগঠিত হওয়ার কোনো প্রয়াস দূর অতীতে লক্ষ করা যায়নি। বাঙলা, বঙ্গ বা বাংলাভাষী অঞ্চল বলতে আমরা যা বুঝি ইতিহাসের কোনো পর্বেই তা প্রকৃত অর্থে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বিরাজিত ছিল না। মূলত বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনে পিষ্ট বাঙালি মানসে ১৯৪৮ সাল থেকে সৃষ্ট ভাষা সচেতনতায় বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি যে রক্তাক্ত প্রতিজ্ঞার জন্ম দিল সেখান থেকেই ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবোধের উন্মেষ। এই প্রথম রক্তে ভিজে বাঙালি নিজেকে চিনলো। আবিষ্কার করলো তার জাতিস্বত্ত্বা। সে কেবল মুসলমান নয়, সে কেবল হিন্দু নয় – সে বাঙালি। এ উপলব্ধিকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন বাঙালি মনীষী জ্ঞানতাপস ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। “আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি”।
ভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরে যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা জাগ্রত হয় তার প্রভাব পড়ে জাতীয় রাজনীতিতে। সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী-মুজিব গড়লেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। পরে আওয়ামী লীগ নাম ধারণ করে পাকিস্তানের সবচাইতে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলে আত্মপ্রকাশ করে। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী চেতনার মূর্ত প্রতিকৃতি শেখ মুজিবুর রহমানের আবির্ভাব হলো অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে। ভাষার দাবি থেকে শুরু করে তারই নেতৃত্বে বাঙালি ধাপে ধাপে এগিয়ে গেল চূড়ান্ত মুক্তির লক্ষ্যে।
৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট, ৫৬’র সংবিধান, ৫৮’র মার্শাল’ল, ৬১’র রবীন্দ্র জন্মশত বার্ষিকী, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯’র গণবিস্ফোরণ, ৭০’র নির্বাচন পেরিয়ে একাত্তরের প্রেক্ষাপটে মার্চের অগ্নিগর্ভ ভেদ করে এলো ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ। হাজার বছরের প্রতীক্ষা শেষে ইতিহাসের সেই মাহেন্দ্রক্ষণে রেসকোর্সের উত্তাল জনসমুদ্রে বজ্র নিনাদে ঘোষিত হলো স্বাধীনতার সেই অমোঘ আহ্বান। কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়Ñ ‘গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপায়ে কবি শোনালেন সেই অমর কবিতা খানিÑ এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। সেদিন থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের হলো।’
বজ্রকণ্ঠের সেই শাশ্বত আহ্বান ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হলো মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোলের মতো। আছড়ে পড়লো শহর-নগর পেরিয়ে গ্রামে-গঞ্জে-প্রান্তরে, ফসলের মাঠে, পদ্মা মেঘনা কর্ণফুলী সুরমার তটে। পাহাড়ের খাঁজে, অরণ্যে, হাটে বাজারে বন্দরে, সেনা ছাউনিতে, পুলিশ ব্যারাকে, সীমান্ত চৌকিতে। স্বাধীনতার মর্মবাণী পৌঁছে গেল কৃষকের উদার বুকে, মাঝির উদাস অন্তরে, শ্রমিকের পেশিল বাহুতে, ছাত্রের অধ্যবসায়ে, শিল্পী সাহিত্যিকের মননে, কবিতার ছন্দে, গানের সুরে, শিক্ষক-অধ্যাপকের মেধায় জ্ঞানে, সেনা পুলিশ মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বে। বাঙালি এক হয়ে গেল স্বাধীনতার সেই মোহনবাঁশির টানে। দীর্ঘ লালিত স্বাধীনতার অনির্বচনীয় আকাক্সক্ষা প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘোষণার মধ্যে দিয়ে বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম সশস্ত্র যুদ্ধের অনিবার্য স্তরে পৌঁছে গেল। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না হলেও কার্যত স্বাধীনতা ঘোষণায় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এমন সুকৌশলী মহাকাব্যিক ভাষণের জন্য প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক সাময়িকী ‘নিউজ উইক’ তখনই বঙ্গবন্ধুকে ‘রাজনীতির কবি’ বলে আখ্যায়িত করেছিল তাদের প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে।
ইতিহাস ডাক দিয়ে যায় কারো কণ্ঠে। শতাব্দীর প্রতীক পুরুষ যার জন্ম না হলে একাত্তরের প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হতো না সেই বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠই বাঙালির স্বদেশ আবিষ্কার, সেই কণ্ঠেই স্বাধীনতার ডাক, স্বাধীনতার ঘোষণা। ৭ই মার্চ কেবল একটি ভাষণেই সীমাবদ্ধ নয়, বাঙালির নাড়ির স্পন্দন, স্বাধীনতান্মুখ কোটি জনতার সাথে অন্তরের গভীরতম অথচ প্রকাশ্য কথোপকথন। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে বাঙালির সকল গৌরবগাঁথার সাথে একাত্তরের মুক্তিপাগল বাঙালির ঐক্যসূত্র, এক সুদৃঢ় সেতুবন্ধন। বাঙালি জেগে উঠলো সিরাজের দেশপ্রেমে, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার শৌর্যে, খুদিরামের ফাঁসির দড়ির ঐশ্বর্যে, সূর্যসেন-প্রীতিলতার আত্মদানের গৌরবে, সালাম, রফিক, জব্বার, মনু মিয়া, আসাদ, মতিউর, শামসুজ্জোহার রক্ত আর অজ¯্র আত্মত্যাগের মহিমায়।
বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নয়। ৭ই মার্চ এমনি এমনি সৃষ্টি হয়ে যায়নি। এমন শাশ্বত আহ্বান, এমন অমোঘ ঘোষণা দেবার অধিবার বা ভিত্তি ঘটনাপ্রবাহের আকস্মিকতা নয়। লক্ষ কোটি জনতার হৃদস্পন্দন অনুভবে, অন্তরের ভাষা পাঠ করে, সাড়ে সাত কোটি বাঙালির আস্থা অর্জনের নিরন্তর সাধনার ফসল এই ৭ই মার্চ। এ কঠোর সাধনা সাধিত হয়েছে মাসের পর মাস, কারান্তরালের নির্জন প্রকোষ্ঠে, ফাঁসির দড়িতে গলা বাড়িয়ে, পাকিস্তানের ক্যান্টনমেন্টে হাজারো নির্যাতনে মাথা না নুইয়ে। প্রতিদিন প্রতি কর্মে বাঙালির জন্য নিখাদ ভালবাসায় সেই সাধনা বুকে লালন করেই একদিন ৭ই মার্চে স্বাধীনতা ঝলসিত তর্জনী আকাশ ফুঁড়ে দিয়ে সারা জাতিকে আপন করে নিয়ে তবেই না ডাক দেয়া যায়- ভাইয়েরা আমার…।
২৩ বৎসরের বঞ্চনা-বেদনার আর্তনাদ বক্ষে ধারণ করেই তো বলা যায়Ñ আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বুঝেন… বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। তীব্র আকাক্সক্ষার উচ্ছ্বাসে আর ন্যায্যতার অধিকারে তবেই বলা যায় আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।
উনিশ মিনিটে এক হাজার একশ সাতটি শব্দে সাজানো কথামালায় স্বাধীন বাংলার এক প্রচ্ছদপট এঁকে দিয়ে সেই অমোঘ মন্ত্রের উচ্চারণÑ এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
কি ছিল না এই কথামালায়। প্রতিটি উচ্চারণে মূর্ত হয়ে উঠেছে বাঙালির অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক মুক্তি। অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সামাজিক মূল্যবোধ, যুদ্ধের কৌশল, প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলায় করণীয়, যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার ক্ষণ, এমনকি তার অবর্তমানে কি করণীয় তাও বিবৃত হয়েছে দ্বিধাহীন-জড়তাহীন সহজ আর সুদৃঢ় প্রত্যয়ে।
বস্তুত ৭ই মার্চের ভাষণই ছিল স্বাধীনতার প্রকাশ্য নির্দেশনামা এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন এক অলিখিত সংবিধান। তাই তো নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের প্রতিদিন দুই বার করে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত হতো সেই বজ্রকণ্ঠের অংশ বিশেষ, যা তার অনুপস্থিতিতে উদ্বুদ্ধ করতো যুদ্ধরত বাঙালিকে।
অনেকে ৭ই মার্চের ভাষণকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ভাষণের একটি বলে উল্লেখ করেন। তুলনা করেন আব্রাহম লিংকনের গেটিসবার্গ বক্তৃতার সঙ্গে, বিশ্বযুদ্ধকালীন চার্চিলের বিখ্যাত ভাষণের সাথে। কিন্তু সে সকল ভাষণ ছিল সুলিখিত এবং দীর্ঘ চিন্তিত। আর ৭ মার্চের ভাষণটি অলিখিত। হৃদয় থেকে উৎসারিত, আবেগে আপ্লুত অথচ সত্যের প্রত্যয়ে দৃঢ়। বঙ্গবন্ধুর ঘাড়ের পেছনে খোলা তলোয়ার, মাথার উপরে ঘূর্ণায়মান সামরিক হেলিকপ্টার, সামনে উদ্বেলিত জনসমুদ্রের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের চাপ। এমন পরিস্থিতিতে মাহকাব্যিক ব্যঞ্জনার এমন স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ এক এবং অনন্য।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com