1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ০৫:৩৯ অপরাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

ফসলরক্ষা বাঁধ : অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে অপচয় ৩০ কোটি টাকা!

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯


শামস শামীম / শহিদনূর আহমেদ ::

সুনামগঞ্জের ৩৭ হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে চলতি অর্থ বছরে প্রায় দুই শতাধিক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এতে সরকারের প্রায় ৩০ কোটি টাকার অপচয়ের আশঙ্কা করছেন কৃষক নেতৃবৃন্দ। বিভিন্ন সময়ে একাধিক ফোরামে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের তদারকিতে নিয়োজিত জেলা কাবিটা বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটিকে অবগত করা হলেও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলো বাতিল করা হয়নি। বরাদ্দ দেওয়া এসব প্রকল্পে তেমন কাজও হয়নি বলে মনে করেন এলাকাবাসী।
সুুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে কাবিটা প্রকল্প বাস্তবায়নে হাওরের প্রায় ৪শ কি.মি. ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বাঁধ নির্মাণে ৫৬৭টি প্রকল্প গ্রহণ করে জেলা কাবিটা মনিটরিং ও বাস্তবায়ন কমিটি। নির্মাণকাজে বরাদ্দ দেওয়া হয় প্রায় ৯৬ কোটি ৩৯ লক্ষ টাকা। ২০১৭ সালে প্রণীত নতুন নীতিমালায় কেবল কৃষক ও বাঁধ এলাকার জমির মালিককে প্রকল্পে স্থান দেওয়ার কথা ছিল। গত বছরের অক্টোবর থেকে নভেম্বরের মধ্যে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নেতৃত্বে গণশুনানির মাধ্যমে তাদের নিয়ে পিআইসি গঠন করার নির্দেশনা ছিল নীতিমালায়। কিন্তু হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনসহ স্থানীয় কৃষক ও সচেতন লোকজন জানিয়েছেন, নতুন কাবিটা নীতিমালা মানা হয়নি প্রকল্প গ্রহণে। ফলে পিআইসি গঠন থেকেই দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি শুরু হয়। রাজনৈতিক প্রভাবে জমির মালিক না থাকা সত্ত্বেও পিআইসি গঠনে স্বজনপ্রীতি করেন সংশ্লিষ্টরা। তবে কাজ আদায় করে নিতে শেষ দিকে পিআইসি সদস্যদের আটক ও মুচলেকার ফলে এই মুহূর্তে এসে কিছু কাজ হচ্ছে বলে মনে করেন কৃষকরা।
হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের একাধিক দায়িত্বশীল নেতা সম্প্রতি ১১ উপজেলার অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলো ঘুরে দেখেন। তাদের মতে ১১ উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত বৃহত্তম ৩৭টি হাওরে প্রায় দুই শতাধিক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প রয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের প্রায় ৩০ কোটি টাকা অপচয় হবে বলে মনে করেন তারা। এই বিপুল সংখ্যক অর্থ অপচয়ে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এসব বিষয়ের প্রতিবাদে সংগঠনটি মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশও করেছে।
হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ সরেজমিন ফসলরক্ষা বাঁধ পরিদর্শন করে জানিয়েছেন- গত বছর বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্তত দুই শতাধিক প্রকল্পের কাজ অক্ষত ছিল। এই বাঁধগুলোর সামান্য অংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু নতুন প্রকল্পে পুরো বাঁধেরই প্রকল্প করে অধিক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এসব বাঁধের প্রতিটিতে গড়ে ৮-২২ লাখ টাকা পর্যন্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রকল্প গ্রহণ শেষে বাস্তবায়নের সময় প্রকল্প কমিটির লোকজন উপজেলা কমিটির সভাপতি ও সদস্য সচিবদের সঙ্গে যোগসাজশ করে বাঁধগুলো নতুন দেখাতে উপরের আবরণ সরিয়ে, মাটির নতুন প্রলেপ দিয়েছে। কোদাল দিয়ে উপরের আবরণ ঘসে কোথাও কোথাও একটু-আধটু মাটি ফেলা হয়েছে। এই দুই শতাধিক প্রকল্পে বরাদ্দের এক পঞ্চমাংশ বরাদ্দ দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তারা।
‘হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন’-এর সিনিয়র সহ-সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান সম্প্রতি দিরাই, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, বিশ্বম্ভরপুর ও সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় অন্তত ৪০টি বাঁধ পরিদর্শন করেন। তার মতে এই ৪০টির মধ্যে ২০টি বাঁধের ৯০ ভাগই অক্ষত ছিল। কিন্তু প্রাক্কলন করা হয়েছে পুরো বাঁধের। তাহিরপুর-জামালগঞ্জ নিয়ে বিস্তৃত মাটিয়ান হাওরের সাতটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের চারটি বাঁধই অক্ষত ছিল। প্রতিটি বাঁধেই ১৫-২২ লাখ টাকা পর্যন্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এখন এই বাঁধগুলো উপরের দুর্বা ঘাসের আবরণ সরিয়ে অল্প মাটিতে প্রলেপ দিয়ে নতুন দেখানোর চেষ্টা করছে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির লোকজন। পরিদর্শনে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারি প্রকৌশলী মো. ইমরান হোসেনকে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে বরাদ্দ কেন দেওয়া হলো জানতে চাইলে তিনি তাকে জানান, প্রাক্কলনের সময় বাঁধে পানি থাকায় তিনি যথাযথভাবে ইস্টিমেট করতে পারেননি। পানি সরে যাওয়ার পর পুনরায় কেন প্রাক্কলন করা হলোনা জানতে চাইলে তিনি ওই কৃষক নেতাকে কোন সদুত্তর দেননি। আবু সুফিয়ান জানান, দিরাই উপজেলার রফিনগর ইউনিয়নের ৮টি, দক্ষিণ সুনামগঞ্জের পাথারিয়ায় দুটি, জামালগঞ্জের বেহেলি ইউনিয়নে দুটি, বিশ্বম্ভরপুর ও সদর উপজেলায় আরো চারটি বাঁধ অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। সরেজমিন দেখা এই বাঁধগুলো পুরনো আকৃতিতে থাকলেও এখন প্রলেপ দিয়ে নতুন দেখানো হচ্ছে। তাছাড়া ফসলরক্ষা কাজে নির্মিত অধিকাংশ বাঁধেই উচ্চতা, প্রস্থ ও দৈর্ঘ্য অনুযায়ী মাটি ফেলা হয়নি। লাগানো হয়নি ঘাস। করা হয়নি কমপেকশন। ঘাস ও কমপেকশনেও আলাদা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
শাল্লা উপজেলার ১৭নং পিআইসিকে ২২ লাখ ৮৪ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ১৭৭০ মিটার দৈর্ঘ্যরে এই বাঁধে গত অর্থ বছরেও কাজ করায় বাঁধটি এখনো বেশিরভাগই অক্ষত। তাই এই বাঁধে এতো বরাদ্দের প্রয়োজন ছিলনা বলে মনে করেন স্থানীয় কৃষক কবিন্দ্র চন্দ্র দাস ও নেপাল চন্দ্র দাস। ১০ ও ১২নং প্রকল্পটিতে গত বছর কাজ হওয়ায় এখনো ভালো রয়েছে। কিন্তু এই দুটি প্রকল্পেও ২৫ লাখ টাকার মতো অতিরিক্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ৪২নং প্রকল্পটিও অক্ষত। তারপরও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৮ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। ৩৯নং প্রকল্পে ২০ লাখ ৭২ হাজার টাকা দেওয়া হলেও এটি হাওরের ফসলরক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত নয় বলে স্থানীয় কৃষকরা জানান। কালিকোটা হাওরের ৬৫নং প্রকল্পে ২৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই বাঁধটিতেও অতিরিক্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ছায়ার হাওরের ৭৫নং প্রকল্পের পশ্চিম দিকে মন্নানপুর গ্রাম সংলগ্ন ১৬ লাখ ১৬ হাজার টাকা বরাদ্দের প্রয়োজন ছিলনা বলে স্থানীয়রা জানান। দিরাই উপজেলার চাপতির হাওরের ১১ এর (ক) নং প্রকল্পে ২৩ লক্ষ টাকা, ৩৯নং প্রকল্পে ৮ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা ও ১০১নং প্রকল্পে ১৯ লক্ষ ৪৬ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এই তিনটি বাঁধকে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বলছেন স্থানীয় কৃষকরা। ভাটিপপাড়া ইউনিয়নের ৭০নং প্রকল্পটিও স্থানীয়দের মতে অপ্রয়োজনীয়। এসব অপ্রয়োজনীয় বরাদ্দের বাঁধে কেবল মাটির প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। সদর উপজেলার রঙ্গারচর ইউনিয়নের কাংলার হাওর ৬নং প্রকল্পে ৮ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা অপ্রয়োজনীয় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। একই উপজেলার ৫নং পিআইসিকেও ৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে প্রয়োজন ছাড়াই। ৩নং প্রকল্পেও অধিক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তারা এখন পুরনো বাঁধে কেবল প্রলেপ দিচ্ছেন। এভাবে প্রতিটি উপজেলায়ই প্রয়োজন ছাড়া অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করে সরকারের মোটা অংকের টাকা অপচয় করা হয়েছে বলে মনে করেন কৃষকরা।
গৌরারং ইউনিয়নের নল্লুয়া গ্রামের কৃষক গোলাম জিলানী বলেন, সরকার আমাদের হাওরের জন্য বিপুল বরাদ্দ দিয়েছে। এই বরাদ্দে ভালোভাবে কাজ করলে বাঁধগুলো টেকসই হতো। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি নীতিমালা অনুযায়ী কাজ করেনা। তাছাড়া প্রয়োজন ছাড়াও প্রকল্প দেওয়ায় সরকারের মোটা অংকের টাকা অপচয় করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের এলাকার ৫নং ও ৩নং পিআইসি অপ্রয়োজনীয়। ৩নং প্রকল্পে কেবল মাটির প্রলেপ দিয়ে বরাদ্দ লোপাটের প্রস্তুতি চলছে।
হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা পরিষদের সভাপতি চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, নীতিমালা অনুযায়ী কোথাও কাজ হয়নি। কারণ পিআইসি গঠনেই অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। তাছাড়া অনেক বাঁধে প্রয়োজন ছাড়া অতিরিক্ত বরাদ্দ দিয়ে সরকারের টাকা অপচয় করেছে। কোথাও গণশুনানী করা হয়নি। তাই কৃষকরা মতামত দিতে পারেনি।
হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের সিনিয়র সহ-সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, আমি ৫টি উপজেলায় অন্তত ৪০টি প্রকল্প ঘুরেছি। এর মধ্যে ২০টিকেই অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। এসব বাঁধে অধিক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের হিসেবে ৫৬৭ প্রকল্পের মধ্যে দুশটিই অপ্রয়োজনীয়। এসব অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে প্রয়োজনের চেয়ে ৩০ কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে আমরা প্রমাণ পেয়েছি। এ বিষয়ে আমরা মানববন্ধন, স্মারকলিপিসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ও জেলা কাবিটা মনিটরিং ও বাস্তবায়ন কমিটির সদস্যসচিব মো. আবু বক্কর সিদ্দিক ভূইয়া বলেন, স্থানীয় জনগণের চাহিদার ভিত্তিতে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন করা হয়। উপজেলা থেকেই প্রাক্কলন করে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় বাঁধের ব্যাপারে তিনি বলেন, কিছু বাঁধের ব্যাপারে অভিযোগ এসেছে। আমরা এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করেছি।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com