গত শুক্রবার, ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। সুনামকণ্ঠে একটি বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে। বিজ্ঞাপনটিতে একটি বাংলা বর্ণ পর্যন্ত নেই, সবটাই ইংরেজিতে, এমনকি কর্মকর্তার স্বাক্ষরটিও ইংরেজিতে। বিজ্ঞাপনের বিষয়বাখানটি আপাতত এ পর্যন্তই। এতেই হবে, এর বেশি দরকার নেই।
আমি বিদ্যার জাহাজ নই। বিদ্যা নিয়ে আমার বড়াই নেই। প্রমিত বাংলা কোনওভাবে রপ্ত করেছি, একটু আধটু, সবটা না। ইংরেজিতে একেবারেই অদক্ষ। কিন্তু সহজ বুদ্ধি দিয়ে এটুকু বুঝি যে, ভাষার অধিকার বলে একটা কথা আছ, আর সেটা মানুষ জন্মসূত্রেই পেয়ে থাকে। তাই তার জীবনের আগাগোড়া সবটুকু জুড়েই থাকে ভাষা। পৃথিবীকে বাতাস যেমন ঘিরে রাখে, ভাষা তেমনি মানুষকে ঘিরে রাখে ও মায়ের মতো লালন করে। বর্ণপরিচয় আছে বা নেই, সেটা বিবেচ্য নয়, সব মানুষেরই জীবনযাপন কর্মকা- ও ভাব-উপলব্ধির প্রধান নির্ভরতা ভাষা। অন্যভাষার বিজ্ঞাপন তাই স্বাভাবিকভাবেই মানুষের জন্মগত অধিকারকে খর্বই কেবল করে না, এক ধরনের অসম্মানও করে, মাতৃভাষার জগতে দূষণের বিস্তার ঘটায়।
ইংরেজি একটি সা¤্রাজ্যবাদী ভাষা। কিন্তু এই সা¤্রাজ্যবাদী আগ্রাসী ভাষায় অদক্ষ হলেও পত্রিকায় মাঝে মাঝেই ইংরেজিতে সরকারি বিজ্ঞাপন ছাপাতে হয়। কেন ছাপাতে হয় তা সকলেই জানেন। বিজ্ঞাপনের টাকা পেলে আমাদের কীছুটা সাশ্রয় হয়। এই আর কি। যাঁরা ঠিকাদারি করেন তাঁদের কেউ যে, একেবারে ইংরেজিতে বিদ্যাধর দ্বিগজ প-িত, জানা কথা, তেমন তো নয়। বোধ করি তাঁদেরকে নিজেদের গরজে এই বিজ্ঞাপন বোঝার বিদ্যাটুকু ঠেকে হলেও শিখতেই হয়। ঠেলার নাম বাবাজি। না শিখলেই যে নয়। অন্যথায় তো পেট চলবে না। পকেট গড়ের মাঠ হয়ে ঠা ঠা করবে। ঠিকাদারদের ইংরেজি শিখানোর তাগিদে সরকারি কর্মকর্তা বিজ্ঞাপনটি ইংরেজিতে ছাপিয়ে থাকেন এমনটা অবশ্যই নয়, এবং সেটা কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণও হতে পারে না। তথাপিও একটা কারণ তো থাকা চাই। বিনা কারণে তো গাছের পাতাটিও নড়ে না। তার জন্যও একটু বাতাস তো চাই। ইংরেজিতে বিজ্ঞাপন প্রদানের রহস্যটা আমার কীছুতেই বোধগম্য নয়। অনেকে না বুঝলে কী হবে, কেউই যে বুঝেননি এমন তো নয়। হাতে গোনা কয়েকজন তো অন্তত পাওয়া যাবে যাঁরা রহস্যটার মর্মভেদ করতে পেরেছেন বা পারেন। তাঁর মধ্যে একজন রহস্যটার মর্মোপলব্ধি করেছিলেন তাঁর নিজের মতো করে। এবং তিনি গণমানুষের কাব্যকার, গণকবিয়াল বাউল স¤্রাট শাহ আব্দুল করিম। তাঁর মরমিয়া ভাবনাটা বড়বেশি মাটির সঙ্গে ও মাটির মানুষের সঙ্গে মিলে মিশে গড়াগড়ি করে। তিনি তাঁর এক গানে বলেছেন, “অফিস-আদালতে বাংলার/ হয় যদি পূর্ণ অধিকার/ প্রভুত্ব চলিবে কেমনে/ নগণ্য জঘন্য যারা/ জানে না লেখাপড়া/ উপায় নাই মাতৃভাষা বিনে/ সরস বাঙালি যারা/ বাঙলা ভাষা চায় না তারা/ আব্দুল করিম বুঝে অনুমানে ॥” এই গানের বয়ান উদ্ধৃত করার পর, আমার নিজের পক্ষ থেকে আলাদা করে কোনও বয়ান সৃষ্টির কোনও প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। করিম তো সেই কবে একদিন বলেই দিয়েছেন আমার মনের কথাটি। যাকে আমি মুনসিয়ানা করে বলতে পারি, দেশে এক শ্রেণির ভদ্দরনোক (ভদ্রলোক) আছেন যাঁরা বাংলা পরিহার করার কুকাজের ভেতরে সাধারণ মানুষের উপর প্রভুত্ব করার বাসনাকে এখনও জিইয়ে রেখেছেন।
বিষয়টা একটু বিস্তৃত করা যাক। বাউল করিমের বয়ান থেকেই অনুমান করা যায় যে, বাংলাদেশে এখনও এক শ্রেণির বাঙালি আছেন যাঁরা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নিজেদেরকে আলাদা রাখতে চান এবং এই আলাদাত্ব বজায় রাখার কারণে তাঁরা ইংরেজিকে ভাববিনিময়ের ভাষা হিসেবে ব্যবহার করেন, নিজেরা বাঙালি হয়েও বাংলাভাষা থেকে সরে থাকেন। এই সরে থাকার মধ্যে তাঁরা নিজেকে করে তোলতে চান দেশের অন্য মানুষের প্রভু। প্রভুত্বের আকাক্সক্ষা বড় খতরনাক আকাক্সক্ষা। ইংরেজরা এই আকাক্সক্ষায় আক্রান্ত হয়ে ভারতীয়দের থেকে নিজেদেরকে পৃথক রেখেছিল বিভিন্ন কৌশলে। ভাষায়, পোশাকে-আশাকে, চাল-চলনে, এককথায় ভিন্ন কিংবা বিজাতীয় এক সংস্কৃতির পরিম-ল নিজেদের চারপাশে তৈরি করে। সেই ইংরেজদের ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির প্রাথমিক বশংবদ পাকিস্তানি শাসকরা ও তৎপরবর্তী উত্তরসূরিরা সমাজের আনাচে-কানাচে এখনও বহালতবিয়তে আছেন। তার বিভিন্ন আলামত পাওয়া যায় এবং একটু খেয়াল করলেই টের পাওয়া যায়। যেমন আছেন একধরনের সামাজিক-রাজনীতিক উচ্চপদস্থরা, যারা দেশের মানুষের প্রভু সাজার বড়াই করেন এবং সেট তারা প্রকাশ করেন ইংরেজি শিখে কেবল নয়, পোষাকে-আশাকে, চাল-চলনে, আচার-ব্যবহারে পর্যন্ত ভিন্নতা আনয়ন করে। এই ভিন্নতা তারা প্রদর্শন করেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের পৃথকত্বকে, কিংবা বলা ভালো, প্রভুত্বকে জাহির করতে। তারা ইংরেজিতে বিজ্ঞাপন ছাপান যে-দেশে কোনও ইংরেজিভাষী বাস করে না, যেখানে ইংরেজিতে বিজ্ঞাপন প্রকাশের কোনও সামাজিক বাস্তবতা নেই। বিজ্ঞাপনে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার বোধ করি সাধারণ মানুষের থেকে বিজ্ঞাপনের দ্বারা বিজ্ঞাপিত বিষয়টিকে সম্পূর্ণ আড়াল করার বাসনাকে চরিতার্থ করা। কিন্তু বিজ্ঞাপনের বিষয়টি এমন যে সেটা আড়াল করার কীছু নয়, আসলে ইংরেজিতে বিজ্ঞাপন প্রকাশের একটাই মহিমা, বিজ্ঞাপনদাতারা নিজেরা সাধারণ মানুষের মতো কেউ, সেটা আড়াল করতে চান। অর্থাৎ সাধারণ মানুষকে বলে দেওয়া যে, আমি তোমাদের মতো কেউ নই, আমার একটা আভিজাত্য আছে। এই দেখো আমি ইংরেজি জানি। জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীও ইংরেজি জানতেন। কিন্তু তিনি তার ইংরেজি জ্ঞান কাজে লাগিয়েছেন ইংরেজি জ্ঞানের ভা-ার থেকে বাংলাতে জ্ঞানের ঝর্ণা বইয়ে দেওয়ার কাজে, যাকে বলে, তিনি অনুবাদ করেছেন দেদার, ইংরেজিকে বাংলা করেছেন। ইংরেজি জানার গর্ব তিনি করতেই পারেন। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য ইংরেজি জানার দরকার নেই। ইংরেজি কিংবা অন্য যে-কোনও ভাষা জানতে হবে সেই বিভাষা থেকে জ্ঞান আহরণের মহৎ কাজ সমাধা করার জন্য, স্বজাতির সঙ্গে নিজের ভিন্নতা প্রদর্শনের জন্য নয়। আর তা ছাড়া এই প্রবণতার আর একটি দিক হলো এর দ্বারা দুধের স্বাদ ঘুলে মেটানোর মতো প্রভু মানসিকতার বিজ্ঞাপন প্রচারে চরিতার্থতা অর্জিত হয় বলে তারা মনে করেন। তা করতেই পারেন। মনের উপর তো কারও জোর খাটে না।
ইংরেজিতে বিজ্ঞাপন প্রকাশ, ইংরেজি মিডিয়ামে সন্তানদের পড়ানো, ইংরেজি মিডিয়ামের শিক্ষার প্রসার ঘটানো, আদালতের রায় ইংরেজিতে করা কিংবা ইংরেজি যারা জানেন না সেই অধিকাংশ বাংলাভাষী সাধারণ মানুষদের থেকে কোনও জানার বিষয়কে দূরে রাখার উদ্দেশ্যে বই রচনা করা ইত্যাদি কাজ ঔপনিবেশিক আমলে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই করা হতো। উদ্দেশ্য : একদিকে প্রভুত্বের অহমিকাকে প্রকাশ করা এবং অন্যদিকে উপনিবেশের মানুষদেরকে তথ্য থেকে দূরে রাখা।
বাউল করিমের বয়ান আমাদেরকে কঠিন কথা সহজ করে বলে দেয়। তথ্যবঞ্চনা বা তথ্যবিচ্ছুতি সাধারণ মানুষকে, অজ্ঞ করে দেয়, জ্ঞানী করে তোলে না এবং অজ্ঞতা মানুষকে জাগতিক বিভিন্ন জরুরি বিষয়ে বিজ্ঞ মানুষের মুখাপেক্ষী করে তোলে। অজ্ঞতা মানুষের জ্ঞানের ক্ষমতাকে দুর্বল করে এবং অবশেষে তথ্যওয়ালাদের অধঃস্তন করে রাখে, দাসে পরিণত করে। ব্যাপারটা অনেকটা এমন দাঁড়ায় যে, তথ্যজানার সামাজিক ভাগবাটোয়ারা আসলে প্রভুত্বের অধিকার দেয় তথ্যসম্পদে যারা ধনী তাদেরকে এবং বিপরীতে তথ্যসম্পদে যারা গরিব তারা স্বাভাবিক নিয়মেই দাসে পরিণত হয়। প্রাচীনকালের জ্ঞানীরা বলেছেন, জ্ঞানই শক্তি। তথ্য মানুষকে জ্ঞানী করে অর্থাৎ শক্তিশালী করে। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে তথ্য সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। তাই তথ্য থেকে সাধারণ মানুষকে দূরে রাখাই শাসকদের মধ্যে একশ্রেণির প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিনিধির আপাতত কর্তব্য। তারা সাধারণ মানুষকে প্রাণপণে দূরে রাখতে চায় বিজ্ঞাপন, শিক্ষা, চলচ্চিত্র, গণমাধ্যম, ইন্টারনেট ইত্যাদি সবকীছু থেকে। এই দূরে রাখার একটি মহিমা হলো, কোনও কীছু জেনে ফেললে লোকে সে-বিষয়ে জ্ঞানী হয়ে ওঠে। তখন তাকে আর সহজে ঠকানো যায় না। বেগতিক দেখলে লোকে বিদ্রোহ করে ফেলতে পারে। আমাদের সমাজের প্রভুরা তাই প্রজাদেরকে সহজে কোনও কীছু জানতে দিতে চান না। কারণ জ্ঞানের বিস্তার মানুষের উপর মানুষের প্রভুত্বকে বিনাশ করে।