1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৩৬ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

শাল্লায় বাঁধের কাজে অনিয়ম থামছে না

  • আপডেট সময় রবিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

বাদল কৃষ্ণ দাস ::
সুনামগঞ্জের হাওরে ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ সময়সীমার আর মাত্র ১১দিন বাকি। এখনও অনেক বাঁধের কাজ অর্ধেকও স¤পন্ন করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট পিআইসিরা। হাওরে হাওরে চলছে অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা। হাওর বাঁধ যেন লুটপাটের এক নতুন ক্ষেত্র। এরই ধারাবাহিকতায় অধিক হাওর বাঁধের ক্ষেত্র জেলার শাল্লা উপজেলা প্রশাসনের চোখের সামনেই চলছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাওর বাঁধ নির্মাণে পিআইসিদের নীতিমালা লঙ্ঘন ও সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতি। প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায় থেকে হাওর দুর্নীতি রোধে তোড়জোড় দেখালেও বাস্তবে প্রশাসনিক কঠোরতার কোন সাফল্য দেখা যাচ্ছে না। প্রত্যেকটি প্রকল্পে বাঁধের একেবারে কাছে থেকে মাটি উত্তোলন করা হচ্ছে। এর আগেও এরকম অনিয়ম হয়েছে এসব প্রকল্পে। এভাবে বছরে বছরে একই স্থানে বাঁধের একেবারে গোড়া থেকে মাটি উত্তোলন করার কারণে বাঁধের পাশে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হচ্ছে। শাল্লা উপজেলার কাছে -দূরের সবক’টি বাঁধে সমান তালে বাঁধের নীতিমালা লঙ্ঘন ও সীমাছাড়া অনিয়ম চলছে। বাঁধের অতি কাছে থেকে মাটি উত্তোলন বন্ধ হচ্ছে না, দুরমুজ দেয়া হচ্ছে না মোটেই। প্রশাসনের সতর্ক বার্তাকে গ্রাহ্যই করছেনা পিআইসিরা। এসব অনিয়মের ব্যাপারে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী-২ খুশী মোহন সরকারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বাঁধের সকল ত্রুটি ও অনিয়ম দূর করতে সংশ্লিষ্ট ইউএনও এবং এসওদের চিঠি দেওয়া হয়েছে।
কাবিটা-২০১৭ কর্মসূচির নীতিমালা অনুযায়ী হাওর বাঁধ নির্মাণের ধারেকাছেও থাকছে না কোন পিআইসি। অনেকটা ‘বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো’ ঠিক এভাবেই যেন কচ্ছপ গতিতে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে চলছে হাওর বাঁধের কাজ। বাঁধে বাঁধে বাসা বেঁধেছে নীতিমালা লঙ্ঘন ও অনিয়ম। খোদ বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বে রত এসও শমসের আলী মন্টু স্বয়ং কথা বলছেন পিআইসিদের মতো করে পিআইসিদের ভাষায়। অনেক বাঁধেই অদ্যাবধি সাইনবোর্ড পৌঁছেনি। এবছর হাওর বেষ্টিত শাল্লা উপজেলার দুর্গম এলাকার হাওর বাঁধ নির্মাণে ১১৫টি প্রকল্পের কাজ চলছে। আর এতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে প্রায় ২২ কোটি টাকা। আকার ও আয়তন অনুযায়ী ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে এত বরাদ্দ সুনামগঞ্জ জেলার মধ্যে আর কোন হাওরে নেই। বিগত ২০১৭ সালের অকাল প্লাবনে ফসলহানির আতঙ্কে সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই প্রয়োজনে – অপ্রয়োজনে যেখানে সেখানে অপরিকল্পিত বাঁধের নামে দেওয়া হয়েছে বিপুল অর্থ বরাদ্দ। আর এতে করে সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে নানা কৌশলে। বাঁধের অন্তরালে থেকে প্রকল্পে অনিয়ম করে লাখ লাখ টাকা বাঁচিয়ে লাভবান হচ্ছেন গুটিকয়েক ব্যক্তি। বেছে বেছে কেবল দলীয় লোকেরাই প্রকল্প পেতে প্রাধান্য পাচ্ছে। হাওরবাঁধ নির্মাণে এসব অনিয়ম-দুর্নীতিতে পর্দার অন্তরালে পরোক্ষভাবে জড়িত থাকা রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ভয়ে প্রকাশ্যে কেউ কথা বলতে রাজি হননি। স্থানীয়রা বলছেন প্রতিবছর হাওর বাঁধ নির্মাণ যেন একটা লাভজনক মৌসুমী ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। আর এতে লাভবান হচ্ছে এক শ্রেণির সুবিধাবাদী রাজনৈতিক ব্যবসায়ী। স্থানীয়দের অভিযোগ, রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ে কারণে-অকারণে প্রকল্প সাজানো হয়েছে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে অনেক বাঁধে।
সরজমিনে শাল্লা উপজেলার দুর্গম হাওর বাঁধে গিয়ে দেখা গেছে, কোন বাঁধেই পিআইসি’র কেউ উপস্থিত থাকেন না। ভাড়া করা লোক দিয়ে চালাচ্ছেন বাঁধের কাজ। এস্কেভেটর দিয়ে বাঁধগুলোতে মাটি উত্তোলনের কাজ করায় এস্কেভেটর চালকরা তাদের নিজেদের ইচ্ছামত মতো করে বাঁধ নির্মাণ করছে। এস্কেভেটর দিয়ে কম সময়ে কম খরচে বাঁধের কাজ সেরে ফেলার জন্য পিআইসিরা এই পদ্ধতি বেছে নিয়েছেন বলে কৃষকরা জানান। অনেক বাঁধেই তথ্য সংযুক্ত সাইনবোর্ড নেই। আবার কোন কোন সাইনবোর্ডে পিআইসির ভুল মোবাইল নাম্বার দেওয়া হয়েছে।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি শাল্লা উপজেলার হবিবপুর ইউনিয়নের স্থানীয় ভান্ডা বিল হাওর বর্ধিতাংশের ৪৪নং পিআইসির বাঁধে গেলে বিষয়টি লক্ষ করা গেছে। এসময় পিআইসির সভাপতি ও সদস্য সচিবের কাছে বাঁধে সাইনবোর্ডে নেই কেন জানতে চাইলে তারা জানান, শাল্লা উপজেলার সকল পিআইসির সাইনবোর্ড তৈরির ঠিকাদারি নিয়েছেন সংবাদকর্মী পরিচয় দাতা জনৈক শান্ত কুমার তালুকদার।
বাপাউবো’র এসও একথার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। পরে শাল্লা সদরে শান্ত কুমার তালুকদারের ‘প্রিন্স ক¤িপউটার’ নামক ব্যবসায়িক ঘরে গিয়ে দুই ডজন সাইনবোর্ড দেখা গেছে। অথচ নির্ধারিত ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাঁধের কাজ স¤পন্ন করার বাধ্যবাধকতা থাকার পরেও বাঁধ এলাকায় ১৪/১৫ ফেব্রুয়ারিতেও সাইনবোর্ড পৌঁছায়নি। একাধিক মাধ্যমে জানা গেছে, শান্ত কুমার তালুকদার নিজেকে অনলাইন পোর্টাল দৈনিক শাল্লার খবর ডটকমের নির্বাহী স¤পাদক বলে দাবি করে আসছেন। তার মাধ্যমেই শাল্লা উপজেলার সকল পিআইসির সাইনবোর্ড তৈরির কন্ট্রাক হয়েছে বলে পিআইসির লোকজন জানান। যদিও এসব পলি-সাইনবোর্ড তৈরিতে ৩শ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫শ টাকা খরচ হয়, তথাপি প্রতিটি সাইনবোর্ড তৈরি বাবদ সর্বনি¤œ ১৫শ টাকা করে এই চক্রটি হাতিয়ে নিয়েছে বলে পিআইসিরা অভিযোগ করেছেন।
বিষয়টি তাৎক্ষণিক পানি উন্নয়ন বোর্ডের এসও শমসের আলী মন্টু, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী-২ খুশী মোহন সরকার, শাল্লা থানার অফিসার ইনচার্জ ও জেলা পুলিশ সুপারকে ফোনে অবগত করা হয়। শাল্লা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সাথে মুঠোফোনে বার বার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এদিকে বাঁধের অনিয়মের ব্যাপারে বিভিন্ন তথ্য জানতে চাইলে এসও শমসের আলী মন্টু ফোন রিসিভ করেননি। স্থানীয় বিভিন্ন মাধ্যমে জানা গেছে এসও শমসের আলী মন্টু বাঁধ নির্মাণের পিআইসি এবং সাইনবোর্ড চক্রের সাথে সমঝোতার মাঝে রয়েছেন। উল্লেখ্য যে, উপজেলা প্রশাসনের সন্নিকটে ৭২, ৭৩, ৭৪, ৭৫, ৩৮, ৩৯নং প্রকল্পে গিয়ে বাঁধের কাজে চরম অব্যবস্থাপনা ও পিআইসিদের অবহেলা দেখা গেছে।
শাল্লা উপজেলা প্রশাসনের অতি কাছে ভেড়াডহর হাওর রক্ষার ৩৯নং বাঁধ দিতে গিয়ে রাস্তার পাকা ব্লক উঠিয়ে ফেলা হয়েছে। পিআইসি মাটি কাটছেন বাঁধের কাছে। ঐ একই হাওর রক্ষার বাঁধে ৩৮নং পিআইসি সভাপতিও বাঁধের কাছে থেকেই মাটি উত্তোলন করছেন। ৭৫নং বাঁধে একই অবস্থা চলছে। ৭২, ৭৩নং প্রকল্পে বাঁধের কাজ থমকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ৭২নং পিআইসি সভাপতি মধু মিয়াকে বাঁধের স্থলে পাওয়া যায়নি। সাইনবোর্ডে মোবাইল নাম্বার না থাকায় যোগাযোগ করাও সম্ভব হয়নি। উপজেলা প্রশাসনের অতি কাছের সবকটি প্রকল্পেই নীতিমালা লঙ্ঘন করেছেন পিআইসিরা। ৪৫নং উদগল বিল হাওর প্রকল্পের পিআইসি সভাপতি জ্যোৎ¯œা রানী দাসকে পাওয়া যায়নি। তিনিও বাঁধের গোড়া থেকে মাটি উত্তোলন করিয়েছেন। সাইনবোর্ডে ভুল মোবাইল নাম্বার দেওয়ায় তার সাথে ফোনে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
ছায়ার হাওরে অবস্থিত ৭২, ৭৩, ৭৪নং প্রকল্পে গিয়ে দেখা যায়, বাঁধের একেবারে গোড়া থেকে এস্কেভেটর দিয়ে মাটি উত্তোলন করা হয়েছে। লাগোয়া সুলতানপুর গ্রামের মুজিবুর রহমান, ধানুমিয়া জানান, পিআইসিরা বরাদ্দের টাকা আত্মসাত করার জন্য অতি কাছে থেকে মাটি তুলে বাঁধের কাজ সেরে ফেলতে চাইছেন এবং হাওর বাঁধের মেরুদ- দুর্বল করে দেওয়া হচ্ছে। এতে ফসলরক্ষা বাঁধের ক্ষতি হচ্ছে। এখনও ৭২, ৭৩নং পিআইসির কাজ অধিকাংশই বাকি রয়ে গেছে। পাশাপাশি ৭৪নং বাঁধেও একেবারে গোড়া থেকে মাটি কাটা হয়েছে। পিআইসির ০১নং, ৪৩নং, ১০২নং, ১০৩নং বাঁধে গিয়ে কোন সাইনবোর্ড পাওয়া যায়নি। ১০৩ নং পিআইসির সভাপতি আব্দুল গণি মিয়া জানান, তিনি উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থীদের প্রচারণার কাজে ব্যস্ত আছেন তাই সাইনবোর্ড লাগানোর সময় পাচ্ছেন না।
ভান্ডা বিল হাওরের ৪৪নং পিআইসির বাঁধে গেলে স্থানীয় সুকলাইন গ্রামের বিপ্লব চন্দ্র দাস, রঘুনাথপুর গ্রামের হরকুমার দাস, রামকৃষ্ণ দাস জানান, এই বাঁধ তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটা না হলেও চলে। এরকম আরো অনেক অপ্রয়োজনীয় বাঁধের কাজ প্রকল্পে টেনে আনা হয়েছে। সেখানে এত বিপুল ব্যয়ে বাঁধ নির্মাণ না করে কম বরাদ্দ দিয়ে প্রয়োজনীয়তা বুঝে বরাদ্দ দেওয়া যেত। অপ্রয়োজনীয় অনেক বাঁধের নামে প্রকল্পের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে অধিক, কিন্তু সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয়তা ছিল না।
স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, এইরকম মোটাসোটা করে বড় বরাদ্দের প্রকল্প সাজানোই হয়েছে টাকা মেরে খাওয়ার জন্য। তাদের মন্তব্য হচ্ছে, শাল্লা উপজেলার ১১৫টি প্রকল্পের পিআইসি সভাপতি ও সদস্য সচিব এই দু’জন করে হিসেবে নিলে অন্তত ২৩০ জন প্রত্যক্ষভাবে কয়েক লাখ টাকার মালিক হয়ে যায়। এর আগেও যারা পিআইসিতে যুক্ত ছিলেন তাদের প্রত্যেকেই লাখ লাখ টাকার মালিক হয়েছেন। তাইতো পিআইসির সভাপতি-সক্রেটারি হবার জন্য কামড়াকামড়ি লেগে যায়। আর এসব পিআইসি সভাপতি-সেক্রেটারি নিয়োগে লবিং করেন রাজনৈতিক পরিচয়ের ধান্দাবাজ নেতারা। কারণ তারাই নামে-বেনামে এক বা একাধিক পিআইসিতে জড়িয়ে থাকেন পরোক্ষভাবে। জমির প্রকৃত মালিকদের পিআইসিতে অন্তর্ভুক্তি অবহেলিত রয়ে গেছে। যে কারণে জনসাধারণ বলে আসছেন, “প্রশাসন নীতিমালার কঠোরতার কথা বললেও বাস্তবে অ্যাকশনে যেতে পারেন না।” হাওর ফসলের প্রকৃত মালিক সাধারণ কৃষকদের অভিমত হচ্ছে- হাওর নীতিমালার যথাযথ প্রয়োগ হোক। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের প্রভাবকে প্রাধান্য না দিয়ে হাওর নীতিমালা অগ্রাহ্যকারী পিআইসিদের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com