বেশ কীছু দিন আগে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল জামালগঞ্জ উপজেলার বেহেলি ইউনিয়নের বৌলাই নদীতে শতাধিক বালিবোঝাই স্টিলের নৌকা আটকা পড়ে আছে। নদীর নাব্যতা না থাকায় এই নৌকাগুলো সুরমা নদীতে গিয়ে পড়তে পারছে না। গতকালের দৈনিক সুনামকণ্ঠ সংবাদশিরোনাম ছিল ‘ভরাট ও দখলের কবলে সুরমা নদী’। এই সংবাদশিরোনাম কিংবা সংবাদপ্রতিবেদন মানবসভ্যতাকে একটি সংবাদ পরিবেশন করছে সেটি হলো সভ্যতাবান্ধব নদীপ্রকৃতি ভারসাম্যহীনতার শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পত্রিকায় লেখা হয়েছে, ‘বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই নদীর গতিপথ নষ্ট হচ্ছে, নাব্যতা হারাচ্ছে ও চর পড়ছে বলে মনে করেন বিশেজ্ঞরা। পুরান সুরমা ও মরা সুরমা এখন বলতে গেলে মৃতপ্রায়।’
জলের আরেক নাম জীবন। জল ছাড়া জীবনের অস্তিত্ব কল্পনারও অতীত। সভ্যতা জল ছাড়া বাঁচে না। তাই প্রাচীন প্রায় সভ্যতাই গড়ে উঠেছে নদীকে সঙ্গী করে, কোনও না কোনও নদীর তীরে। নদী বিশ্বমানবতার সম্পদ। নদী কারও ব্যক্তিগত সম্পদ হতে পারে না। নদীর উপর জনগণের সর্বজনীন ও কালোত্তীর্ণ মালিকানা স্বীকৃত, সেটা কেউ খর্ব করার কোনও অধিকার রাখে না। নদীদখল যে-কোনও বিবেচনায় একটি অনধিকার চর্চা এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
ভুলে গেলে চলবে না যে, নদী ও জঙ্গলের আশির্বাদ ছাড়া সভ্যতা সম্ভব নয়। জল ও জঙ্গল মানুষের খাদ্যের ভা-ার এবং নদীর জলে লবণ নেই এবং বৃক্ষ অক্সিজেন সরবরাহ করে। জমিতে যে-শস্য-সবজি ফলানো হয় তাও এক অর্থে মানবসভ্যতার জন্য জঙ্গলেরই উপহার।
পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। সভ্যতার প্রয়োজনে বনভূমি ও জলাধারগুলো মানুষ দখল করে নিয়ে স্থাপনা গড়ছে, তদুপরি প্রকৃতিবিনাশী বিভিন্ন মানবকর্মকা-ের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ নদীগুলো ভরাট হয়ে নাব্যতা হারাচ্ছে এবং কালক্রমে মরা নদীতে পরিণত হয়ে জনবসতি গড়ার মতো ডাঙায় পরিণত হচ্ছে। অর্থাৎ এই করে করে পৃথিবী ক্রমে ক্রমে জীবন বাঁচে এমন জলের অভাবে পড়বে। এজন্য কেউ কেউ বলেন, পৃথিবীতে জলের সমুদ্রগুলো থাকার পরও তৃতীয় মহাযুদ্ধ হবে জলের অধিকার নিয়ে।
প্রতিবেদনে সুরমা নদী সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘… দীর্ঘ এই নদী যাত্রাপথে নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে আছে। স্থানে স্থানে জেগেছে চর। ভরাট হয়ে গেছে। বিভিন্ন স্থানে তীরও দখল করে স্থাপনা তৈরির হিড়িক দেখা গেছে।’ এই যখন অবস্থা, তখন মানুষকে বুঝতে হবে, নদী বাঁচলে মানুষ বাঁচবে, নদী বাঁচলে সভ্যতা বাঁচবে। নদী ভরাট হওয়া, নদীতে চর পড়া কিংবা দখল হওয়া, এইসব কর্মকা- যে-করেই হোক, বন্ধ করতে হবে। কারণ এইসব কর্মকাণ্ড চূড়ান্ত বিচারে সভ্যতাবিরোধী। যে-সভ্যতা নদীকে মারে, সে-সভ্যতা প্রকারান্তরে সভ্যতাবিরোধী। সকল কথার সার কথা, সভ্যতাবিরোধী সভ্যতার বিকাশকে থামাতে হবে। আর থামাতে না পারলে এই পৃথিবী নামক গ্রহ থেকে নির্বাসনে যাওয়ার কিংবা অন্য গ্রহে উপনিবেশ তৈরির প্রকল্প এখনই হাতে নিতে হবে মানুষকে। যে-গ্রহে জল থাকবে না, জানা কথা, সে-গ্রহ মানুষের বাসযোগ্য থাকবে না।