শুধু সংস্কৃতিতে নয়, আপামর জনসাধারণের জীবন ও জীবিকা, চলাচল ও যোগাযোগ, কৃষি ও শিল্প, পেশা, ব্যবসা ও বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ, গঠন, পরিবর্ধন ও বিস্তারে নদীর প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে। সেই নদীবাহিত জীবন ব্যবস্থা আজ ধ্বংসের মুখে। এর কারণ নদী ভরাট, দখল ও দূষণ। নদীকে দখলমুক্ত করে ড্রেজিং বা খনন করে নদীর নাব্য ফিরিয়ে দেওয়া গেলে নদীবাহিত জীবন ব্যবস্থা ধ্বংসের কবল থেকে রক্ষা পাবে।
বেলজিয়ামে উচ্চশিক্ষার সময়ের স্কেলড রিভার পুনর্বাসন কাজের অভিজ্ঞতা ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদী খননের জানা অভিজ্ঞতার আলোকে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, পরিবেশ প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ হিসাবে অংশগ্রহণমূলক নদী খনন ব্যবস্থা বিষয়ে প্রস্তাবনা ও আলোচনা করবো।
স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশে নৌপথের দৈর্ঘ্য ছিল ২৪ হাজার কিলোমিটার। বর্তমানে পলি ও বালি দ্বারা ভরাট হতে হতে সেই নৌপথ কমতে কমতে চার হাজার কিলোমিটারে ঠেকেছে। এই নৌপথের চার ভাগের এক ভাগ মাত্র শুষ্ক মৌসুমে নৌ-চলাচল উপযোগী থাকে। নদীর নাব্য রক্ষার জন্য বছরে ৭০-৮০ লাখ ঘনমিটার পলি-বালি ড্রেজিং বা খনন করার প্রয়োজন হলেও বিআইডব্লিউটিএ মাত্র ৩০ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং করতে পারে। এই ড্রেজিংগুলো করা হয় নদীর বিশেষ এলাকায়, যা পুরা নদীর নাব্যের ওপর কোনও প্রভাব রাখে না। সরকারি প্রতিষ্ঠানের এই ব্যর্থতা অংশগ্রহণমূলক নদী খননের ব্যবস্থার মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব। এই পদ্ধতি প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করে মরা ও আধমরা নদীর জীবন ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব। বাংলাদেশ সরকারের প্রতিষ্ঠান বিআইডব্লিউটিএ’র পক্ষে বিপুল পলি-কাদা অপসারণ করা অর্থনৈতিকভাবে সম্ভব নয়। তাছাড়া এই প্রতিষ্ঠানের সেই সক্ষমতাও নাই। নদী ভরাটকারী পলি, বালি ও কাদামাটির বিভিন্ন উপযোগিতা রয়েছে। সেই উপযোগিতা অনুযায়ী নদী খননের ব্যবস্থা করলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, শ্রেণি-পেশার মানুষ নদী খননে উদ্বুদ্ধ হয়ে অংশগ্রহণ করতে পারেন।
বালি একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণ উপাদান। বাংলাদেশের নির্মাণ শিল্পে এর বিপুল চাহিদা রয়েছে। ঘর-বাড়ি নির্মাণ, রাস্তাঘাট-ব্রিজ কালভার্ট নির্মাণসহ বিভিন্ন কাজে বালির প্রয়োজন। নদীতে প্রাপ্ত বালির একটি বিশেষ সুবিধা রয়েছে, তাই এর দাম ও চাহিদা বেশি। নদীর বালিতে মিনারেল বা খনিজ লবণ কম থাকে বা মোটেও থাকে না। তাই নির্মাণ কাজে এই বালি সিমেন্টের সঙ্গে বাধাহীন বিক্রিয়া করতে পারে। নির্মাণের পরে কংক্রিট ও প্লাস্টার লাল হওয়াসহ বিভিন্ন বিকৃতি হতে রক্ষা পায় এবং স্থায়িত্ব বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া পলি-কাদা মিশ্রিত বালি, যা ভিট বালি নামে পরিচিত তার ব্যবহার রয়েছে নিচু জমি ভরাট করে উঁচু করা ও রাস্তা সম্প্রসারণ কাজে। বাংলাদেশের নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ও ফার্মগুলোকে আলোচনাসাপেক্ষে বিভিন্ন নদীর বিভিন্ন অংশ থেকে ড্রেজিং করে বালি ব্যবহার করার ব্যবস্থা করা গেলে সহজেই নদী খনন করে নাব্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব। ফলস্বরূপ নদী খননের জন্য সরকারের বিপুল ব্যয় কমিয়ে আনা সম্ভব। তাছাড়া নৌচলাচল বৃদ্ধি পেলে কম খরচে পণ্য পরিবহনে সুবিধা বৃদ্ধিসহ সাধারণ জনগণের জীবন-মান উন্নয়ন হবে।
নদী ভরাটে শুধু বালি থাকে না, থাকে পলি, কাদা ও হিউমাস। বালির মতো এই পলি, কাদা ও হিউমাসের বিশেষ ব্যবহার আছে। এই ব্যবহার বিষয়ে সঠিকভাবে অবহিত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে নদী খনন অংশগ্রহণমূলক করা সম্ভব। সাধারণত নদীতে পলি, কাদা ও হিউমাস আসে বৃষ্টির পানির সঙ্গে ওয়াশআউট হয়ে। নদীর আশপাশের ও উজানের ভূমি ক্ষয়ের ফলে গাছের জন্য বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান ধৌত হয়ে নদীতে জমা হয়। তাছাড়া বিভিন্ন জৈবদ্রব্য পচনের ফলে হিউমাস তৈরি হয়, যা নদীর তলে জমা হয়। এই জমা হওয়া পুষ্টি উপাদান নদীতে ইউট্রফিকেশন সৃষ্টি করে। ফলে নদীতে বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ ও আগাছা জন্মে এবং পর্যায়ক্রমে সময়ের ব্যবধানে নদী মজে যায়। এই প্রক্রিয়ায় পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হতে থাকে এবং নদী মরতে শুরু করে। এসব পুষ্টি উপাদানের বিশেষ ব্যবহার আছে কৃষিক্ষেত্রে। জমা পলি-কাদা কৃষি জমিতে প্রয়োগ করলে মাটির পানিধারণ ক্ষমতা বাড়ে এবং ভূমিক্ষয় রোধ হয়। হিউমাস হচ্ছে জৈব দ্রব্য যা কৃষি জমিতে জৈব সারের ভূমিকা পালন করে।
নদীর এই পলি, কাদা ও হিউমাস কৃষি জমিতে প্রয়োগ করলে জমির উৎপাদনশীলতা বাড়ে, পানি সেচ কম লাগে ও চাষ দেওয়ার পরিমাণ কমে যায়। প্রকৃতিক লাঙল কেঁচোর বংশবিস্তারে সহায়তা করে। ফলস্বরূপ কৃষক ও দেশ লাভবান হতে পারে। নদীর পাড়ের গ্রাম ও জনপদগুলোর কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হলে তারাই অংশগ্রহণ করে নদী খননে এগিয়ে আসতে পারে। এখানে দরকার কৃষি বিভাগ ও বিআইডব্লিউটিএ-সহ বিভিন্ন সংস্থার সমন্বিত কার্যপরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন।
নদী খনন করলে নদীর ইকোলজি বা বাস্তুতন্ত্রের পরিবর্তন হয় বা নষ্ট হয়। এই নষ্ট হওয়াকে কম পর্যায়ে রেখে নদী খনন করা একটি কঠিন কাজ।
তবে দুটি অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করতে পারি, যা বাংলাদেশে প্রয়োগ করা যেতে পারে। বেলজিয়ামের স্কেলড নদীর দূষণ রোধ ও নাব্য বৃদ্ধির জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য গেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. নীলস ডি পাউ স¤পৃক্ত হলেন। ইকোলজির অধ্যাপক হিসাবে আমরা ওই প্রকল্প ফলো করি এবং বাস্তব জ্ঞান অর্জন করি।
এখানে নদীকে আংশিক শুকিয়ে ফেলে পলি-কাদা তুলে ফেলা হয় এবং পলি-কাদা থেকে বিশেষ পদ্ধতিতে দূষণ দূর করে কৃষি জমি ও গ্রিনহাউজে ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ২০০০ সালের বন্যার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া নদীগুলোকে ড্রেজিং করে নাব্য বৃদ্ধি করা হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে বন্যার পানি দ্রুত নেমে যায়। উল্লেখ্য, সে সময় বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলেও বন্যা হয়েছিল। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নদী খননের আগে নদীপাড়ের মানুষদের স¤পৃক্ত করা হয়। নদী খনন করে মাটি দিয়ে এলাকার হাজা-মজা গর্ত ও নিচু জমি ভরাট করা হয়। নদীর তলানির ওপরের অংশ আলাদাভাবে ড্রেজিং করে কৃষি জমিতে ব্যবহার করেছে। ইকোলজির ক্ষতি কমাতে দুটি ক্ষেত্রেই থেমে থেমে আংশিকভাবে ড্রেজিং করা হয়েছে। অর্থাৎ ঘোলা পানি থিতিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত পরবর্তী অংশ ড্রেজিং করা হয়নি। কারণ, ঘোলা পানিতে মাছ ও জলজ প্রাণীর কানকুয়া বন্ধ হয়ে যায় এবং শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যায়। তাছাড়া ড্রেজিং করার আগে ইকোলজির গুরুত্ব অনুযায়ী বিভিন্ন জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদকে বিশেষ উপায়ে সংরক্ষণ করা হয়। পরবর্তীতে নদীতে জলজ প্রাণীদের ছেড়ে দেওয়া হয় ও উদ্ভিদকে প্রতিস্থাপন করা হয়।
বাংলাদেশের মরণাপন্ন ও প্রায় মরে যাওয়া নদীগুলোকে রক্ষা এবং জলপথ সংরক্ষণ ও বৃদ্ধির জন্য নদী খননের বিকল্প নেই। সেই খনন প্রক্রিয়া ইকোলজি ও পরিবেশের ক্ষতি না করে সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে করা দরকার। পানি উন্নয়ন বোর্ড, নদী গবেষণা, কৃষি বিভাগ ও বিআইডব্লিউটিএ-সহ বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যৌথভাবে পরিকল্পনা ও প্রয়োগ কার্যব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে। সে অনুযায়ী স্থানীয় প্রশাসন ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের স¤পৃক্ততার মাধ্যমে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। আশা করি বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও পরিকল্পনাকারী কর্তাব্যক্তিরা নদীরক্ষায় এগিয়ে আসবেন এবং সমন্বিত অংশগ্রহণমূলক নদী খনন প্রক্রিয়া শুরু করবেন। অংশগ্রহণমূলক নদী খনন প্রক্রিয়া ছাড়া বাংলাদেশের মরণাপন্ন নদীগুলোকে রক্ষার আর কোনও বিকল্প নেই বলে আমার মূল্যায়ন ও বিশ্বাস।
[লেখক: অধ্যাপক, ফার্ম স্ট্রাকচার অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ]