অনেকেই কেবল মনে করেই তৃপ্ত থাকেন না, এমন কি বলেও থাকেন যে, বিএনপি একটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতিক দল বা বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কোনও রাজনীতিক দল নয়। প্রকৃতপ্রস্তাবে মানুষের এইরূপ ভাবনা মোটেও ঠিক নয়। যাঁরা এইরূপ ভাবেন বা যাঁরা এইরূপ ভাবনায় প্ররোচিত হন প্রকারান্তরে তাঁরা মিথ্যাকে নিজের অজান্তেই আঁকড়ে ধরেন কিংবা প্রতারিত হন। যে যে-ভাবেই ভাবুন না কেন বা যে যে-রকম ধারণাই পোষণ করুন না কেন, এরকম ভাবনা বা ধারণাপ্রপঞ্চ কোনওভাবেই সত্যকে স্পর্শ করে না, অন্তত বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রপঞ্চ এইরূপ ধারণাকে সত্য বলে প্রতিপন্ন করে না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে যারা ক্ষমতা দখল করেছিল, তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কেউ হতে পরে না। শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাকারী ঘাতকদের যারা পুনর্বাসিত করেছিল, চাকরি দিয়েছিল, রাজনীতিক ও আর্থিক সুবিধা দিয়েছিল তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কেউ হতে পারে না। যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিল এবং সহযোগিতা করেছিল তাদেরকে বিচারের সম্মুখীন না করে যারা সমাদরে রাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসীন করেছিল, তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কেউ হতে পারে না। স্বাধীন বাংলাদেশে যে-যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল আইন করে, সে-আইন বাতিল করে যুদ্ধাপরাধী রাজনীতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে রাজনীতি করার অধিকার প্রদান করেছিল যারা তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কেউ হতে পারে না। কতিপয় কুলাঙ্গার বাদে দেশের সাধারণ মানুষ যে-যুদ্ধাপরাধী রাজনীতিক দলকে ঘৃণা করেন সে-দলের সাহচার্য ত্যাগ না করে সে-যুদ্ধাপরাধী দলকে সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করে যারা, তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কেউ হতে পারে না। দুই দশকাধিক কালব্যাপী দেশের উন্নতির চাকাকে যারা থামিয়ে রাখার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রাজনীতি করে তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কেউ হতে পারে না।
আমরা সাধারণ মানুষেরা এভাবেই বিষয়টিকে নিতান্ত সাদামাটাভাবে দেখে থাকি কিংবা বিবেচনা করে থাকি। এই বিবেচনা করার মধ্যে অন্য কোনও কেরদানি-ক্যারিসমা নেই। সুনামগঞ্জ পৌরসভার আয়োজনে অনুষ্ঠিত এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য প্রদানের সময় একজন সাবেক বিচারপতি যখন বলেন, “জামায়াত ও বিএনপি’র মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। দু’টিই মুক্তিযুদ্ধকে বিশ্বাস করে না।” তখন তাঁর এই কথাটি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মনের কথারই পুনরোক্তি হয়ে উঠে। আসলে একজন বিচারপতির কণ্ঠ ১৭ কোটি মানুষের কণ্ঠ হয়ে যায়। জেনে রাখা ভালো, এই বিচারপতি বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। তাঁর মতো বিদগ্ধ বিচারপতির এই অভিমত প্রমাণ করে যে, আসলে এ বিষয় (জামায়াত ও বিএনপি’র মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই) নিয়ে বিতর্কের কোনও অবকাশ থাকতে পারে না। অর্থাৎ জামায়াত ও বিএনপি রাজনীতিক দিক থেকে একই মতাদর্শের অনুসারী কিংবা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দল এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বলেই স্বাধীনতাবিরোধীও বটে। ইতিহাস সচেতন যে-কেউ তাঁর সাথে একমত পোষণ করবেন এবং করাটাই স্বাভাবিক ও যুক্তিসঙ্গত।