1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১:২০ অপরাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

সাধারণের মাঝে এক অনন্যসাধারণ আব্দুল হেকিম তালুকদার : ইকবাল কাগজী

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ৮ নভেম্বর, ২০১৮

এমনিতে তিনি অসাধারণ কেউ নন, চেহারা-চরিত্রে নিতান্তই সাধারণ একজন মানুষ। গ্রামের আর পাঁচজনের মতোই একজন। কিন্তু গ্রামীণ সমাজের পরিসরে তাঁর ব্যক্তিত্বের একটা বিশিষ্টতা ছিল সেটা স্বীকার করতেই হয়। সেখানেই তিনি ছিলেন সকলের চোখের আড়ালে এক আলাদা মানুষ। আর এমন বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মানুষ বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে যে একবারে বিরল তাও নয়। আগের মতো প্রবল প্রতাপের সঙ্গে না হলেও গ্রামীণ সমাজব্যবস্থায় এখনও পুরনো পঞ্চায়েতী প্রথার অবশেষ একধরনের বিচারব্যবস্থা টিকে আছে, যাকে লোকেরা বিচার বৈঠক কিংবা শালিশ-বৈঠক বলে জানে।
এটি একটি জানা বিষয় যে, গ্রামের লোকেরা এই কদিন আগেও নিজেদের মধ্যে সংঘটিত বিরোধ-ফ্যাসাদের নিষ্পত্তিকরণে এই বিচার-শালিশের উপরই একান্তভাবে নির্ভরশীল ছিল, তারা পারতে খুব একটা আইন-আদালতের দ্বারস্থ হতো না। যদিও এখন আর ততোটা নয়, মানুষ এখন আইনের আওতায় বলতে গেলে বন্দি জীবন যাপন করে। এই অদূর অতীতেও কীছু কীছু মানুষ সেইসব বিচার-শালিশের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠতেন, তাঁদের নিজ বিচার-বিচক্ষণতা ও চারিত্রিক সততা-দৃঢ়তার বদৌলতে। আবদুল হেকিম তালুকদার(১৯১৫-২০১৭) তাঁর যাপিত জীবনকালের গ্রামীণ সমাজপরিসরে ছিলেন তেমনি একজন সৎ, নির্লোভ, ন্যায়পরায়ণ, দৃঢ়চেতা কিন্তু অন্যদিকে আবার নিতান্ত সহজসরল আটপৌরে এক মানুষ। প্রিয়জনদের কাছে পরিচিত ছিলেন হাকিম উল্লা।
আবদুল হেকিম তালুকদার ১০ জুলাই ১৯১৫ সালে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নের জগাইরগাঁও গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তাঁর জন্ম । পিতা মো. তোতা মিয়া তালুকদার এবং মাতা মোছাম্মৎ হাজেরা বেগম তালুকদার।
টুকেরগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবনের শুরু এবং গৌরারং মধ্যবঙ্গ ইংরেজি (এম.ই.) স্কুলে সমাপনী শেষে পারিবারিক কারণে তাঁর শিক্ষাজীবনে ছন্দপতন। বাবার বড় ছেলে হিসেবে শিক্ষাজীবন সমাপ্তির আগেই পরিবার পরিচালনার দায়িত্ব নিতে হয় তাঁকে গ্রামসমাজের স্বাভাবিক নিয়মে। অর্থাৎ পারিবারিক পরিস্থিতিটাই এমন হয়ে দাঁড়ায় যে শিক্ষার্জনের চেয়ে পরিবার পরিচালনার জোয়াল কাঁধে তুলে নেওয়াটাই প্রকারান্তরে বড় হয়ে উঠে তারঁ কাছে। পাঠশালা ছেড়ে তাঁকে যেতে হয় প্রকৃতির মাঠে। বলা যায় কৈশোর পেরোবার আগেই চাষবাস, জমিজিরুত-ফসল তদারকি ইত্যাদির সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে হয়। এককথায় বাবার সঙ্গে কৃষিকাজে কোমর বেঁধে নামতে হয় আর কি। কিন্তু তারপরও দমে যাননি তিনি, থেমে থাকেনি তাঁর চেষ্টা। তিন বছর পর তিনি আবার ঠিক ভর্তি হন তাঁর প্রিয় বিদ্যাপীঠ সরকারি জুবিলী হাই স্কুলে। সকালে হালচাষে বাবাকে সাহায্য করেন, পাঁচ কি.মি. পায়ে হেঁটে সুনামগঞ্জে বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করেন। সত্যিকার অর্থেই পরিস্থিতিটা ছিল পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে প্রতিকূল। অদম্য আবদুল হেকিম জীবনের এই প্রতিকূলতাকে জয় করেছিলেন। প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে লেখাপড়ার সঙ্গে ঠিকই জড়িয়ে থাকেন তিনি এবং সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলী হাই স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু ভাগ্য তারঁ প্রতি সুপ্রসন্ন ছিল না। এক এক করে তিন তিন বার প্রবেশিকা পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েও তিনি কৃতকার্য হতে পারেননি, বাধ্য হয়েই তাঁকে শিক্ষাজীবনের ইতি টানতে হয়। তারপর শুরু তাঁর কর্মজীবন। বেছে নেন শিক্ষকতার মত মহান পেশা এবং দীর্ঘদিন জগাইরগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন, কৃতিত্বের সঙ্গে। গৌরারং ইউনিয়নের প্রথম চেয়ারম্যান শ্রীনগেন্দ্রকুমার চৌধুরীর মেয়াদকালে তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে ট্যাক্স কালেকটরের দয়িত্ব পালন করেছিলেন।
আব্দুল হেকিম তালুকদারের দাদা খুর্শেদ তালুকদার ছিলেন এলাকার বিত্তশালী মানুষ এবং এলাকায় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের একজন। সবার কাছে মলই তালুকদার নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন। সুনামগঞ্জ অঞ্চলে চুনের ব্যবসায় যে কয়জন সফলতা অর্জন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে মলই তালুকদার ছিলেন অগ্রগণ্য। দাদার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে ঈর্ষণীয় বিচারজ্ঞান অর্জন করেছিলেন আব্দুল হেকিম তালুকদার। সুনিপুণ ও বিচক্ষণতার সঙ্গে বিচারকার্য সমাধা করতে তিনি ছিলেন বিরল দক্ষতার
অধিকারী। একজন সৎ ও দক্ষ ন্যায়বিচারক হিসেবে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি ছিল। আশপাশের গ্রাম এলাকায় গ্রাম্য সালিশ-বৈঠকে তাঁর উপস্থিতি ছিল অনিবার্যভাবে অবধারিত। এরই ধারাবাহিকতায় একসময় তাঁকে সিলেট জজকোর্টের জুরি বোর্ডের সদস্য মনোনীত করা হয়েছিল। সেখানেও তিনি সততা এবং দক্ষতার সঙ্গে তাঁর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
১৯৬৫ সালে প্রথম বারের মত গৌরারং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তখন স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের প্রবর্তিত জনপতিনিধি নির্বাচনের পদ্ধতির নাম ছিল মৌলিক গণতন্ত্র। জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল প্রশ্নাতীত। সে-জনপ্রিয়তার প্রমাণস্বরূপ মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালে ভাইস চেয়ারম্যান ও আবার ১৯৮৪ সালে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। এই বৎসরই সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা চেয়ারম্যান দেওয়ান জয়নুল জাকেরীন বিদেশ সফরে যান। তখন আবদুল হেকিম তালুকদার ভারপ্রাপ্ত উপজেলা চেয়াম্যানের দায়িত্ব অত্যন্ত সততা ও দক্ষতার সঙ্গে পালন করেন।
জনপ্রতিনিধিত্ব সামাজিক ও রাজনীতিক ক্ষমতায়নের একটি প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি। সমাজপরিসরে এই ক্ষমতা জনকল্যাণে ব্যবহৃত হতে পারে নাও হতে পারে। ক্ষমতায়ন ব্যক্তিকে মাঝে মাঝেই সততার পথ থেকে বিচ্যুত করে, করে তুলে জনবিরোধী এবং মাঝে মাঝেই কোনও কোনও জনপ্রতিনিধিকে নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায়। কিন্তু জনপ্রতিনিধিত্বর দায়ভার আবদুল হেকিমকে ব্যাপক জনস¤পৃক্ততার সঙ্গে যেমন ওতপ্রোত করে তুলে তেমনি শেষ পর্যন্ত তাঁকে করে তুলে জনসেবক অর্থাৎ জনদরদি সমাজসেবক। তাঁর এই সমাজসেবী পরিচিতিটি আজীবন অম্লান ছিল। তাই সামগ্রিক বিবেচনায় বলা যায়, সমাজসেবাই ছিল তাঁর জীবনের মুখ্য ব্রত। বিচারকার্য সমাধানের স্বার্থে দিনের পর দিন গ্রামে গ্রামান্তরে দিনরাত কাটিয়ে দিয়েছেন অনায়াসে। এ দিক থেকে বিবেচনায়, এক অর্থে, সংসারের প্রতি তিনি ছিলেন নিতান্তই উদাসীন। এ হেন আব্দুল হেকিম তালুকদার, জগাইরগাঁও সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয়ে দুই বার এবং হাজী লাল মামুদ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ১২ বছর সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন।
তার জীবনব্যাপী এইসব কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে এই মানুষটি ছিলেন সাধারণ মানুষদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এক অন্যরকম মানুষ। হাজার মানুষের ভিড়ে তাঁকে আলাদাভাবে যদিও চেনা যেতো না তবু তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থে এক অনন্যসাধারণ এবং আজকালের দিনে তো অবশ্যই বিরল।
২০১৭ সালের ১০ আগস্ট রাত ৮টা ৩৫ মিনিটে তাঁর বড় ছেলে আবু সুফিয়ানের হাসননগরস্থ বাসায়, ১০২ বছর বয়সে এই কীর্তিমান মানুষের বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান ঘটে।
এতক্ষণ যে-আবদুল হেকিম তালুকদারের পরিচয় তুলে ধরলাম তারও অধিক একটি পরিচয় তাঁর আছে। সেই আসল আবদুল হেকিমকে চেনার একটি সুলুক সন্ধান দেওয়া দরকার। সেজন্য কেবল এইটুকু বলে রাখি যে, তাঁর এই ছেলে আবু সুফিয়ান একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে তাঁর এই ছেলেটি তাঁর অজান্তে, অর্থাৎ মা-বাবকে না বলে, মুক্তিযুদ্ধে চলে গিয়েছিল। তিনি তাঁর এই ছেলেটিকে দেশের জন্য দিয়ে দিয়েছিলেন। অথচ তিনি নিজে যুদ্ধকালের নয় নয়টি মাস ছিলেন অরক্ষিত ও শত্রু পরিবেষ্টিত।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com