বাঙালি জাতিসত্তার আত্মপরিচয় উদ্ধারের ক্রন্তিকাল অতিক্রম করছে। এই ক্রান্তিকাল অতিক্রমের সুস্পষ্ট সূচনা পরিলক্ষিত হয় বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে ভাষাশহিদদের আত্মত্যাগের মহিমালোকের প্রদীপ্ত বিচ্ছুরণে। প্রতিবন্ধকতা যে ছিল না তেমন নয়, বরং প্রতিবন্ধকতা ছিল ভীষণ তীব্র। তীব্র প্রতিরোধের বিপরীতে বাঙালিরর আত্মজাগৃতির আন্দোললন ছিল আরও বেশি প্রচ- ও বেগবান। শেষ পরিণতি ১৯৭১-এর স্বাধীনতার য্্ুদ্ধ।
১৯৭৫-এর রাজনীতিক পটপরিবর্তন ছিল অনেকটাই প্রতিবিপ্লবের মতো একটি ঘটনা, বাঙালি জাতিসত্তার মুখ পিছন দিকে ফিরিয়ে দেওয়া। কবি কাজী নজরুল ইসলাম তখনও বেঁচে ছিলেন। কবি মূকস্থবির না হলে দেশে এই রাজনীতিক পরিবর্তনকে হয় তো বলতেন, ‘ফাঁকিস্থান’-এর দিকে যাত্রা করা। তখন থেকেই বাঙালি জাতিসত্তার আত্মপরিচয় বদলে দেওয়ার প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রনীতি কার্যকর করা হয় বাংলাদেশে। মুক্তিযুদ্ধের সর্বপ্রকার অর্জন ও পরিপুষ্ট সংস্কৃতিকে পরিকল্পিত উপায়ে মুছে দেওয়া ও নষ্টকরণের বিভিন্ন প্রকার কার্যক্রম শুরু হয়, রাজধানী থেকে দেশের প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত, দেশের সর্বত্র, সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রে। পাঠ্য বইয়ে লিখে দেওয়া হয়, বাংলাদেশি জাতীয়তার ভিত্তিতে সংগঠিত হয়েছে বায়ান্নের ভাষা অন্দোলন। অর্থাৎ বাঙালি জাতীয়তার ভিত্তিতে নয়। ১৯৭৫-এর পর, ক্ষমতা দখলের সঙ্গে সঙ্গে, মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি স্মৃতিকে মুছে দেওয়ার পরিকল্পনায় বদ্ধপরিক হয়ে ওঠে একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা। তারা ‘জয় বাংলা’র স্থলাভিসিক্ত করে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’কে। ইতিহাস থেকে মুছে দিতে শুরু করে শেখ মুজিবের নাম। স্বাধীনতার ঘোষক করে তোলে জিয়াকে। বিভিন্ন ধরণের সরকারি নথিপত্র, আলামত ধ্বংসের মহোৎসবে মেতে ওঠে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনীতিক শক্তি। সুযোগ সুবিধামতো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দেশের ব্যভূমিগুলি একে এক নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে থাকে। বিশেষ করে বধ্যভূমিগুলোকে বেছে বেছে বিশেষ প্রযতœ সহকারে দখল করে নিয়ে সে-জমিতে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে, এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে বধ্যভূমির স্থলে সৌচাগার পর্যন্ত তৈরি করতে কসুর করা হয় না। এদিক থেকে সুনামগঞ্জও ব্যতিক্রমী কোনও স্থান নয়। এখানেও ঘটেছে বধ্যভূমি নিহ্নিকরণের বিভিন্ন কার্যক্রম ও ঘটনা। বধ্যভূমির চিহ্নিত স্থানের গুরুত্বকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে উপেক্ষা করে সুনাগঞ্জের পিটিআই (প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র)-এর ভেতরস্থ বধ্যভূমিটির স্থানে নির্মিত হয়েছে আবাসিক স্থাপনা। এখানের বধ্যভূমিটি এতোই বিখ্যাত যে, তৎকালের কর্তৃপক্ষের বিষয়টি অজানা ছিল, এমন দাবি কোনও যুক্তিতেই প্রতিষ্ঠা পাবে না। পত্রিকান্তরে পিটিআই বদ্যভূমির প্রকৃত স্থান চিহ্নিত করে সেখানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ নির্মাণের দাবি উঠেছে জেলা সদরের মুক্তিযোদ্ধাগণের পক্ষ থেকে।
ভাষা আন্দোলনের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাঙালি জাতিসত্তার উজ্জীবন ও জাগরণের উৎসমূল। এই উৎসমূলকে নির্মূল করতে পারলে বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশকে স্থবির করে দেওয়া খুব সহজ। এই দুরভিসন্ধিতে অনুপ্রাণিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের বধ্যভূমিগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে চিরতরে বাঙালিদের স্মৃতি থেকে মুছে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল ১৯৭৫-এর রাজনীতিক পটপরিবর্তনের পর এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে দীর্ঘ দুই দশকব্যাপী এই কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে, সমগ্র দেশজুড়ে। কোনও বাঙালিই চায় না এই দেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি মুছে যাক। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি বধ্যভূমি প্রত্যেকটি শহিদ পরিবারের জন্য কেবল নয় প্রতিটি বাঙালির জন্য পবিত্র স্মৃতির স্থান। সেই পবিত্র স্মৃতির স্থানগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক কারও কাম্য নয়। সুনামগঞ্জের পিটিআইয়ের বধ্যভূমির উপরে নির্মিত স্থাপনা অপসারণ করে সেখানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হোক। ভুলে গেলে চলবে না মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি থেকে বাঙালি যতোটা সরে থাকবে বাঙালি ততোটাই বাঙালি হিসেবে নিকৃষ্ট মানুষে পরিণত হবে, ছোট হতে থাকবে অন্য জাতিসত্তার মানুষের কাছে এবং প্রকারান্তরে নিজেকে সম্মানের ও গৌরবের স্থান থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে, ক্রমে ক্রমে ।