1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:১১ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

কবি আলফাজ উদ্দিন ও তাঁর কবিতা : মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী

  • আপডেট সময় শনিবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৮

সাহিত্য-সংস্কৃতির এক অনবদ্য অংশ কবিতা। মননের চিন্তা-চেতনা, প্রেম দ্রোহ ও জাতি স্বত্তার সরূপ উদঘাটিত হয়ে থাকে কবির কবিতায়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন অনেক ক্ষণজন্মা কবিরা রয়েছেন যাঁরা নিজেদের ভাব প্রকাশের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলেন সমাজ সংস্কৃতির বাস্তব চিত্র। লেখনির মাধ্যমে ছন্দে ছন্দে মনের সবটুকু উজাড় করে থাকেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত। কিন্ত নানা সঙ্কট ও সমস্যায় অনেক মেধাবী কবিদের লিখনী মূল্যায়িত হয়না। যুগ যুগ ধরে অযতœ অবহেলায় ডায়রীতে লিপিবদ্ধ থাকে মননের সব অভিব্যক্তি কবিতার ছন্দগুলো। তাঁদের মধ্যে অজোপাড়া গ্রামের প্রচার বিমুখ এক কবি বীরমুক্তিযোদ্ধা আলফাজ উদ্দিন। তিনি সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের টেংরাটিলা (আজবপুর) গ্রামের বাসিন্দা। তিনি ১৯৫৪ সালে নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার আজকিতলা গ্রামে নানা বাড়িতে এক মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। শিশু কালে কবি আলফাজ উদ্দিনের পিতা আফসার উদ্দিন দোয়ারাবাজার উপজেলার টেংরাটিলা এলাকায় স্ব-পরিবারে চলে আসেন।
স্কুল জীবনে মনের আনন্দে অদম্য সুন্দর, সুশৃংখল শব্দের বুননে ও ছন্দের ঝংকারে কবিতা লিখতেন আলফাজ উদ্দিন। মূলত শিক্ষা জীবনেই কাঁচা হাতে কলম ধরে মনের সব কথন গুলো লিখেন কবিতার ছন্দে। তাঁর কলমের খোঁচায় ফুটে ওঠে জীবন মানের বাস্তব কল্প-কাহিনী। ব্যক্তি ও দেশপ্রেম, নদী নালা, পশ্চাদপদ জনপদ, বনভূমি, ফসলের মাঠ, মুক্তিযুদ্ধ এবং প্রকৃতির অপরূপ পটভূমি। ২০১২ সালে খোঁজ পাই অজোপাড়া গাঁয়ের নীরব ওই কবির। সংবাদপত্রের সঙ্গে জড়িত থাকার সুবাদে গল্প আর কথার মাঝখানে অযতেœ অবহেলায় পুরনো ডায়রীর পাতায় পড়ে থাকা ওই কবির লেখনী কয়েকটি কবিতা নিজেই আবৃত্তি করে শোনান। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন আমার নামের ‘হেলালী’ শব্দের অর্থ। বাংলায় অর্থ খোঁজে বের করেন ‘নবচন্দ্র’। চেয়ারে বসে লিখতে শুরু করণে কবিতা। কেন জানি গ্রামের ওই কবি একটু আবেগ প্রবণ হয়ে ‘নবচন্দ্র ’ শিরোনামে লিখে ফেললেন কবিতা।
তাঁর প্রকাশিত ‘‘শিহরণ’’ ক্ষুদ্র কাব্য গ্রন্থেও ‘নবচন্দ্র’ শিরোনামের একটি কবিতায় তোলে ধরেন তাঁর মনের কিছু অভব্যক্তির কথা-
‘‘মরিচিকাময় জীবন আমার, ধূ ধূ ময় বালুচর/ঘূর্ণি বাতাসে শূন্যে উড়ায়, আসে যদি একটু ঝড়। ভীবিষিকাময় জীবনের পাতা, তিলে তিলে হইয়াছে ক্ষয়/বার বার আমি হোঁচট খেয়েছি, তাই তো এখন করিনা ভয়।/অজোঁপাড়া গাঁয়ের কত যে রতœ, কেউ তো তারে করে না গো যতœ/ভাবেনা তো কেউ করেনা সন্ধান, আভিজাত্যের থাকেনা যে মান।/পলিমাটি নিয়ে এসেছো তুমি, কে তুমি আগন্তক/বালুকা রাশিতে করিতে বাগান, তোমার কেন হইলো শখ।/করিবে বাগান সাজাবে ঢালি, করিয়াছো তুমি পণ/মধূর রসের বাণীতে তোমার, ভরে গেল মোর মন/শুকনো ডালে ফুটাইলে ফুল, জুঁই চামেলী-বেলী/আধার রারের নবচন্দ্র তুমি, পাইলে মোর পূষ্পাঞ্জলী।’’
সেই কিশোর বয়স থেকে দারিদ্র্যতার সঙ্গে যুদ্ধ করেই তাঁর বেড়ে ওঠা কবি আলফাজ উদ্দিনের। সত্তরের দশকে তিনি লিখেছিলেন ‘ঝরে গেল’ শিরোনামের এই কবিতাটি-
‘‘মনের বাগানে এসেছিল হায়, সুন্দর এক ফুলের কলি/না ফুটেই ঝরে গেল আবার, বাগান করে খালি।’’
একাত্তরে ছিলেন তিনি দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে লেখাপড়ার ইতি ঘটিয়ে কবি আলফাজ উদ্দিন সক্রিয় ভাবে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শেষে দেশ মাতৃকা রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। তখনো থেমে ছিলেন না তিনি। অস্ত্রের যুদ্ধের সঙ্গে চালিয়েছেন কলম যুদ্ধও। ডায়রীর পাতা গুলো আজো সেই সময়কার লেখনীতে ভরপুর। অসংখ্য কবিতার মধ্যে ‘শ্লোগান’ শিরোনামে তাঁর একটি কবিতা-
‘‘বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।/এইতো হলো স্বাধীনতার প্রথম শ্লোগান, সবার কণ্ঠে শুরু হলো জয়বাংলার গান।’’
শিহরণ কাব্য গ্রন্থের ২২ লাইনের এই শ্লোগান কবিতায় একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার কথা বিশেষভাবে ফুটে ওঠেছে।
দেশ স্বাধীনের পর যুদ্ধ ফেরত কবি আলফাজ উদ্দিন ‘ষোলই ডিসেম্বর’ শিরোনমে একটি কবিতায় তাঁর আকুল মনের ব্যাকুল অভিব্যক্তির কথা তুলে ধরেছেন-
‘‘কণ্ঠে সবার জয় ধ্বনি আজ হৃদয় পিঞ্জরে মর্মর স্বর, ফিরে এলো আবার / সেই ষোলই ডিসেম্বর। অসুস্থ, জননীকে শয্যায় রেখে, সন্তান গিয়ে ছিলো রণে/ ঘুরিয়াছে সে নয়টি মাস, খালে বিলে আর বনে।’’
এ রকম অসংখ্য তাঁর স্ব হস্তে লিখিত কবিতা রয়েছে প্রচার বিমুখ গ্রামের ওই কবির। এখন বয়সের ভারে ন্যূব্জ। শেষ বয়সে উপনীত হয়ে তিনি এখনো লিখছেন কবিতা। অতি পরিচিত, সহজ শব্দের গাঁথুনিতে কবির ভাব প্রকাশিত হয়েছে প্রতিটি কবিতায়। স্ব রচিত কবিতা গুলো আবৃত্তি করলে এখনো বুঝা যায় তিনি এখনো তারুণ্য দীপ্ত সুরেলা কণ্ঠের অধিকারী।
স্বাধীনতাত্তোর কবি আলফাজ উদ্দিন জীবন-জীবিকার তাগিদে বাংলাদেশ সেনা বাহিনীতে চাকুরী করেন। সেখানেই হাতে খড়ি তাঁর একজন সংস্কৃতি কর্মী হিসেবে। ১৯৭৫ সালে গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর ক্যন্টনমেন্ট সেনানী বাসে সর্ব প্রথম বড় পরিসরে মঞ্চস্থ শ্রী ব্রজেন্দ্র কুমার দে রচিত ‘‘চাষার ছেলে’’ নাটকে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। চাকুরী হতে অবসরে এসেও তিনি ক্ষান্ত হননি। লেখনীর পাশাপাশি দোয়ারাবাজার উপজেলার বর্তমান সুরমা ইউনিয়নের টেংরাটিলায় গ্রামীণ সংস্কৃতির বিকাশ ঘটান। তৎকালে প্রত্যন্ত এলাকায় যাত্রাপালা, মঞ্চ নাটকে অভিনয় করে মাতিয়ে তুলেন দর্শক-শ্রোতাদের। সেই সূচনা থেকে আজো টেংরাটিলা দোয়ারাবাজার উপজেলার মধ্যে গ্রামীণ সংস্কৃতি বাহনের অন্যতম এলাকা।
যৌবনে কথা সাহিত্যের প্রতিও ছিল তাঁর গভীর মনোনিবেশ। ১৯৯৫ সালে উপন্যাস ‘‘কাঠের বাকসো’’ ১৯৭৮ সালে লিখেন ‘‘ব্যাংকের কেরানি’’। কিন্ত শত পাতার লেখনীর সেই ডায়েরী আজো পড়ে আছে অযতœ-অবহেলায়। অর্থনৈতিক দৈন্যদশা আর প্রকাশনা জগতের আপাত দৃষ্টিতে মূল্যায়িত না হওয়ায় অপ্রকাশিতই রয়ে যায় তাঁর রচিত দুটি উপন্যাস। পুরনো ছেঁড়া ডায়রীর পাতা গুলো পড়লে মন ভরে যায়। তাঁর নিখুঁত রচনা ও কবিতার পঙক্তিতে সুন্দর ভাবে ফুটে ওঠেছে সুনামগঞ্জ তথা কবির আবাস ভূমি দোয়ারাবাজার ও ছাতক উপজেলার অতীতের নানা দৃশ্যপট। এছাড়া প্রেম-বিরহ, বিচ্ছেদ তখনকার সাহিত্য-সংস্কৃতির বিষয়ক প্রায় অর্ধ শত কবিতা আজো আলোর মুখ দেখেনি। অনেক বার তিনি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নিলেও সাড়া পাননি কোনো প্রকাশনা সংস্থার। জীবনে নিজের রচিত কবিতার গুরুত্বও হয়তো খতিয়ে দেখেননি তিনি। পরিণত বয়সে উপনীত হয়ে আগের মতো উচ্ছাস ও শক্তি কোনোটিই নেই তাঁর। সংসার-পরিবার ও জীবন জীবিকার তাগিদে কেটেছে তার ফেলে আসা সময়। এখন লেখনীর পাশাপাশি স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি নিত্য দিনের সঙ্গী। তারুণ্যদীপ্ত হৃদয় যেন আজো তাঁর আজো তাড়া করে কবিতার প্রতি। ছন্দে আনন্দে লেখা তাঁর কবিতার ভাষা যেন মন ভরিয়ে দেয় সাহিত্য প্রেমীদের।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com