শামস শামীম, ডলুড়া সীমান্ত হাট থেকে ফিরে::
বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্ত এলাকার মানুষের খুচরো কেনা কাটার জন্য সুনামগঞ্জ ডলুড়া সীমান্ত হাট চালু হলেও এখন এই হাটে কোন খুচরো পণ্য বিক্রি হয়না। বাংলাদেশ-ভারতের ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে খুচরো পণ্য বিক্রি না করে পাইকারি বিক্রি করছে। গত চার বছর ধরে এভাবে পাইকারি বিকিকিনি চলছে বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন। খুচরো বিক্রি বন্ধ থাকায় বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তের লোকদের জন্য যে লক্ষ্যে হাটটি চালু হয়েছিল সেই লক্ষ্য পূরণ হচ্ছেনা। খুচরো কেনা কাটা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এলাকাবাসী। এই সুযোগে মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের কাছ থেকে তাদের অতিরিক্ত দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। উল্লেখ্য ২০১২ সালের ৩০ মে সদর উপজেলার জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের ডলুড়া গ্রামে সীমান্ত হাটটি চালু হয়েছিল। শুরুর পর থেকেই প্রতি মঙ্গলবারে হাট বসছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালের অক্টোবর মাসে ভারতের নয়া দিল্লীতে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে সীমান্ত এলাকায় দ’ুদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ও সহযোগিতা বাড়ানোর লক্ষ্যে সীমান্ত হাট স্থাপনে যৌথ চুক্তি সম্পন্ন হয়। সীমান্ত হাটে দুই দেশের স্থানীয় উৎপাদিত পণ্য ক্রয় বিক্রয় হওয়ার কথা। ভারত-বাংলাদেশ অংশে দুই দেশের ২৫ জন করে ব্যবসায়ী ব্যবসা করার কথা থাকলেও বাস্তবে আরো অনেকেই ব্যবসা করছেন। চুক্তি অনুযায়ী প্রথমে দুই দেশের সীমান্ত এলাকার ৫ কি.মি. এলাকার ক্রেতাদের জরুরি পণ্য খুচরো কেনা কাটার কথা ছিল। শুরুতে একজন ক্রেতা ৫০-১০০ ডলার পর্যন্ত কেনাকাটার প্রস্তাব করা হয়েছিল। পরবর্তীতে দূরত্ব ও কেনা কাটার পরিধি সীমিত করা হয়। তবে দুই দেশেরই ষ্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে কেবল খুচরো পণ্য বিক্রির। কিন্তু হাট প্রতিষ্ঠার দুই বছর পরই বদলে যায় চিত্র। খুচরোর বদলে দুই দেশের ব্যবসায়ীরা জোট করে পাইকারি বিক্রির দিকে ঝুঁকে পড়েন। সীমান্ত হাটকে কেন্দ্র করে একটি সিন্ডিকেট পাইকারি বিকিকিনি চালাচ্ছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। দুই দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনেই খুচরো বিক্রি বন্ধ থাকলেও তারা ব্যবসায়ীদের কিছু বলছেন না। এতে সীমান্ত এলাকার মানুষসহ জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে খুচরো কিনতে যাওয়া মানুষজন কেনা-কাটা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পরবর্তীতে বঞ্চিত ক্রেতারা বাধ্য হয়ে পাইকারদের কাছ থেকে দ্বিগুণ দামে চাহিদার পণ্য কিনতে হয়। অভিযোগ রয়েছে, সীমান্ত হাটের স্থানীয় ব্যবসায়ীদের বদলে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বড় ব্যবসায়ীরা এসে পাইকারি পণ্য কিনে নিয়ে যান। এর আগে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে চাহিদার কথা জানিয়ে দেয়। বাজারের দিন স্থানীয় কার্ডধারী সুবিধাবাদীদের ম্যানেজ করে সেই পণ্য খালাস করে থাকে।
সরেজমনি মঙ্গলবার দুপুরে সীমান্ত হাটে গিয়ে দেখা যায় ভারতীয় অংশে ব্যবসায়ীদের বস্তাভর্তি পণ্য পড়ে আছে। সেই পণ্য ঘিরে দরদাম করছেন বাংলাদেশের সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা। খুচরো বিক্রির জন্য কয়েকজন ক্রেতা ভারতীয় ব্যবসায়ীদের অনুরোধ জানালেও তারা সাড়া দেননি। তারা খুচরো বিক্রি করবেন না বলেও জানিয়ে দেন। তবে বাংলাদেশ অংশে কিছু ব্যবসায়ী দোকান খুলে খুচরো বিক্রি করতে দেখা গেছে। ভারতীয় অংশে মাত্র ২ জন ব্যবসায়ীকে খুচরো বিক্রির জন্য পসরা সাজাতে দেখা গেছে।
সীমান্ত হাট ঘুরে দেখা গেছে কসমেটিকস, জুতা, কমলা, পান, গরম মশলাসহ সব ধরনের ভারতীয় পণ্যই এখন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা পাইকারি দামে বিক্রি করছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা খুচরো বিক্রি করতে আগ্রহী নন। তাই ভারতীয় অংশে সকাল থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত পণ্যগুলো বস্তাবন্দি হয়ে থাকতে দেখা গেছে। সরেজমিন দেখা গেছে ভারতীয় কমলা বিক্রেতারা একশ কমলা ৫০০-৬০০ টাকা দাম চাচ্ছেন। কিন্তু খুচরো কিনতে চাইলে বিক্রি করেন না তারা। পরবর্তীতে এই কমলা বাংলাদেশি পাইকারদের কাছ থেকে দ্বিগুন দামে কিনতে হয় ক্রেতাদের। তাছাড়া ভারতীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে খুচরো কিনতে চাইলেও তারা পাইকারদের পরামর্শে দেড়গুণ মূল্য চান গ্রাহকদের কাছে।
কোণাগাও গ্রামের ইউপি সদস্য মো. আব্দুল হাই বলেন, আমার সামনে এক মহিলা ভারতীয় দোকানদারের কাছে এক জোড়া জুতা কিনতে চেয়েছিলেন। দাম বলেছিল ৩০০ টাকা। কিন্তু এক জোড়া করে বিক্রি না করে পাইকারি বিক্রি করতে চাওয়ায় তিনি জুতা কিনতে পারেননি। এভাবে অন্যান্য পণ্যও খুচরো কিনতে পারেননি ওই মহিলা।
নারায়ণতলা গ্রামের ডলি আক্তার বলেন, বর্ডার হাটে এখন আর কোন জিনিস খুচরো কেনা যায়না। প্রথম দুই বছর কিছু কেনা গেলেও এখন বন্ধ রয়েছে। তিনি জানান, দুই দেশের ব্যবসায়ীরা মিলে এটা বন্ধ রেখে সাধারণ মানুষদের বঞ্চিত করছে। তিনি বলেন, আমি ৫ হালি কমলা কিনতে চেয়েছিলাম। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বিক্রি না করায় পরবর্তীতে বাংলাদেশি পাইকারদের কাছ থেকে দ্বিগুণ দামে কিনেছি।
ভারতের বালাটের কসমেটিক্স ব্যবসায়ী জগু দে বলেন, আমরা বেশিরভাগ পণ্যই পাইকারি বিক্রি করি। তবে খুচরোও কিছু বিক্রি করি। আগের চেয়ে এখন খুচরো বিক্রি কম বলে স্বীকার করেন তিনি।
ভারতের অপর ব্যবসায়ী (জুতা ব্যবসায়ী) রেংলাল জানান, তিনি এখন আর খুচরো বিক্রি করেন না। তার মতো অধিকাংশ ভারতীয় ব্যবসায়ীই খুচরো বিক্রি করতে চাননা। কারণ হিসেবে তিনি জানান, বাংলাদেশের কিছু লোক তাদের পণ্য চুরি করে নিয়ে যায়। এতে তাদের ব্যবসায় ক্ষতি হয়। এ কারণে খুচরো বিক্রি কমিয়ে দিয়েছেন তিনি।
সীমান্ত হাট ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব জাহাঙ্গীর নগর ইউপি চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা মোকসেদ আলী বলেন, এখন আর এই হাটে তেমন খুচরো বিকি কিনি হয়না। যা হয় পাইকারিই হয়। অনেক মানুষ বিশেষ করে স্থানীয় মানুষ এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। যাদের কারণে হাট বসেছে তারাই যদি সুবিধা না পান তাহলে আমাদের খারাপ লাগে। তিনি বলেন, আগামী সভায় আমি এ বিষয়ে কথা বলব। উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে জরুরি ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করব।
সদর থানার ওসি ও সীমান্ত হাট ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য মোঃ শহীদুল্লাহ বলেন, এ বিষয়ে একবার সভায় এ বিষয়ে কথা হয়েছিল। পরে পরিদর্শনে গিয়ে আমরা ক্রেতাদের কাছে অনেক কেনা পণ্য দেখে জিজ্ঞেস করলে জানান, তারা কয়েকজনের পণ্য বহন করছেন। হাটে এখন খুচরো বিক্রি বন্ধ এ বিষয়ে তার জানা নেই উল্লেখ করে বলেন, এ বিষয়ে আগামী সপ্তাহে বাজারে গিয়ে খোঁজ নিয়ে উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হবে।
সীমান্ত হাট ব্যবস্থা কমিটির (বাংলাদেশ) সভাপতি সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. হারুনুর রশিদের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করলেও তারা ফোন ধরেননি।