সুব্রত দাশ ::
২০১৬ সালের ২০ অক্টোবর আমাদের সকলকে ছেড়ে চিরদিনের মতো চলে গেলেন অ্যাড. সুরেশ দাস। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে যোগদানের জন্য ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলেন। কিন্তু যোগ দেয়া হলো না তাঁর। পথিমধ্যে সিলেটে হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ’ হয়ে পড়লে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় । সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইতিহাসের একজন প্রত্যক্ষদর্শী, শুধুমাত্র একজন প্রত্যক্ষদর্শীই নন, তিনি ছিলেন ইতিহাসের নিষ্টুরতার একজন প্রত্যক্ষ শিকার। তিনি সময়ের সাহসী সৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা এ্যাডভোকেট সুরেশ দাস।
সুরেশ দাস ছিলেন একজন প্রগতিশীল পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ। ছাত্রজীবনেই তিনি প্রগতিশীল রাজনীতির অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯৬২ সনে সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় হতে মেট্রিক পাশ করে তিনি সিলেট এম. সি কলেজে আই. এস. সি ভর্তি হন। কলেজ জীবন শুরু করতে না করতেই তিনি সাবেক ছাত্রনেতা গুলজার আহম্মদের নেতৃত্বে তৎকালীন বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নে যোগদান করেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে ছিল তাঁর সক্রিয় ভূমিকা। গণঅভ্যুত্থানে আইয়ূব খানের পতনের পর জেনারেল ইয়াহিয়া ক্ষমতায় আরোহন করে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল অবাধ ও সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের। এমন প্রেক্ষাপটে উপ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এয়ার ভাইস মার্শাল নূর খান চীন সফর শেষে পশ্চিম পাকিস্তানে না গিয়ে সোজা পূর্ব পাকিস্তানে এসে সাবেক চীফ সেক্রেটারী সফিউল আজমের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতৃবৃন্দের সঙ্গে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল অধুনা শেরাটন হোটেলে যে মিটিং এর আয়োজন করেছিলেন সেই মিটিং এ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ও জগন্নাথ হল শাখার প্রাক্তন সভাপতি হিসেবে যোগদান করেন। ঐ মিটিং এ জগন্নাথ হলের প্রাক্তন ভি. পি সুশান্ত সরকার, ইকবাল হল থেকে তোফায়েল আহমদ (সাবেক ডাকসু ভি. পি ও বর্তমান মন্ত্রী), এফ এইচ হল থেকে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ( সাবেক ও বর্তমান মন্ত্রী), রোকেয়া হল থেকে মালেকা বেগম ও আয়েশা খানম, মহসিন হল থেকে এন. এস. এফ (দোলন গ্রুফ) নাজিম কামরান চৌধুরী সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ যোগদান করেন। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক জনসভায় তিনি সশরীরে উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ ই মার্চের ভাষণের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছাত্র নিজ নিজ এলাকায় চলে গেলেও সুরেশ দাস ও অন্যান্য ছাত্র নেতৃবৃন্দ নিজ নিজ সংগঠনের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য হলেই ছিলেন। ৭ই মার্চের ভাষণের পর কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও বর্তমান শিক্ষা মন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদের নেতৃত্বে পরিচালিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে ডেমি রাইফেল দিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণে তিনি অংশ নেন।
১৯৭১ সালের ২৫ শে মাচের্র ভয়াবহ কালো রাত। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চ লাইট এর মাধ্যমে শুরু করে বাঙ্গালি নিধনযজ্ঞ। সেই হত্যাযজ্ঞের প্রত্যক্ষ শিকার এবং অবিশ্বাস্য রকমভাবে বেঁচে যাওয়া সুরেশ দাস তাঁর এক লেখায় সেই দিনের বর্ণনা দেন এভাবেÑ“ ২৫ শে মার্চ বিকালবেলা আমি গুলিস্তানে গিয়েছিলাম। সন্ধ্যার সময় গুজব শোনা যায় সামরিক আইন জারী হবে। বিভিন্ন স্থানে সামরিক বাহিনী হানা দেবে। সন্ধ্যার সময় পায়ে হেটে ঢাকা মেডিকেল কলেজের পিছনে পপুলার হোটেলে খাওয়া- দাওয়া করে কলেজ হোস্টেলের ভিতর দিয়ে আসার সময় ৪ র্থ পর্বের ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী ড. কামালের সঙ্গে সাক্ষাৎ। তিনি আমাকে জগন্নাথ হলে যেতে নিষেধ করলেন। আমি নিজে কল্পনাও করিনি এমন কোন ঘটনা ঘটতে পারে। তাই আমি তাড়াতাড়ি জগন্নাথ হলে গেলাম। আনুমানিক রাত ১০ টা। শহরে নানা স্থানে ব্যারিকেড ছিল এবং থমথমে ভাব ছিল। জগন্নাথ হলের গেটের সামনে মৃণাল বোস, জীবন সরকার, সত্যরঞ্জন দাস, উপেন্দ্র রায় (অনেকের নাম মনে নেই) এবং দারোয়ান দুখীরাম দাঁড়ানো। তারা সবাই উৎসুক হয়ে কি ঘটতে যাচ্ছে জানার জন্য আমাকে প্রশ্ন করতে থাকে। আমি সবাইকে নির্ভয়ে হলের ভিতর যাওয়ার জন্য বললাম। ভিতরে কিছু আলাপÑ আলোচনা করে আমরা স্ব- স্ব রুমে গিয়ে শুয়ে থাকি। আমি উত্তর বাড়ির উত্তর দিকে ২য় তলায় ১৫২ নং রুমে থাকতাম। আমার সংগে ছিল নরসিংদির শিবপুরের সত্যরঞ্জন দাস। আমরা উৎকন্ঠা ও মানসিক ক্লান্তিতে থাকায় আনুমানিক রাত ১১-৩০ এ শুয়ে পড়ি। ভৌতিক শব্দ শুনে হঠাৎ ঘুম হতে জেগে উঠি। তখন আনুমানিক রাত ১২- ৩০। লক্ষ্য করলাম উত্তরের জানালার কাঁচগুলো ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে রুমের ভিতর অনবরত পড়ছে। ফলে আমরা উভয়ে নিজ নিজ খাটের নিচে শুয়ে পড়ি। কিন্তু শব্দের তিব্রতা না কমায় উভয়ে ছাদের
উপর আশ্রয় নেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। আমরা হামাগুড়ি দিয়ে ছাদের উপর উঠি। ছাদে গিয়ে আরও ০৮ জন ছাত্রকে পাই। তাদের মধ্যে মৃণাল বোস, জীবন সরকার, রবীন সাহা, উপেন্দ্র রায় (অন্যদের নাম মনে নেই) ছিল। আমরা সকলে মিলে পানির ট্যাঙ্কের নিচে শুয়ে পড়ি। কিন্তু চতুর্দিকে নিদারুন হাহাকার ও গুলির শব্দে আমরা ছিলাম সন্ত্রস্ত। হলের মাঠে কমপক্ষে দু’শো পাকসৈন্য এবং একটি ট্যাঙ্ক ছিল। হানাদার বাহিনী হলের শহীদ মিনারটিও সম্পূর্ণভাবে ধ্বংশ করে। ছাদের উপর আমরা আছি কিনা তা জানার জন্য আলোর বুলেট ছুঁড়ত হলের চতুর্দিক দিয়ে হানাদার বাহিনী। রাত আনুমানিক ০৪- ৩০। হলের গেট ভাঙ্গার শব্দ শুনি। গেটের পাশের রুমে দারোয়ান দুখীরামকে পাকসৈন্য গুলি করে হত্যা করে। হানাদার বাহিনী হলের নিচতলার রুমে আক্রমণ করেও অনেক ছাত্রকে হত্যা করে। এদের মধ্যে চট্টগ্রামের বাদল এবং হরিধন দাস হলের পুকুরের পানির নিচে কচুরিপানা মাথায় দিয়ে প্রাণ বাঁচায়। হানাদার বাহিনী প্রত্যেক রুমে আগুন ধরিয়ে দেয়। ভোর আনুমানিক ০৬-৩০ এ ৭ জন হানাদার সৈন্য ছাদের উপরে ওঠে। রাইফেল উঁচিয়ে আমাদেরকে দাঁড়ানোর জন্য বলে। আমরা ১০ জন হাত তুলে দাঁড়াই। তখন পাকসৈন্যরা আমাদের শরীর তাল্লাশী করে। প্রথমে দশজন হতে তিনজনকে একটু দূরে নিয়ে ফল ইন করায়, অর্থাৎ একজনের পিছনে আর একজনকে দাঁড় করায়। এসময় একজন সৈন্য রাইফেল দিয়ে গুলি করে। এবং এতে সবাই মারা যায়। এ লাইনে চট্টগ্রামের রবিন ও অমর ( আর একজনের নাম মনে নাই ) ছিল। তারপর অপরাপর সাতজন হতে তিনজন নিয়ে অনুরুপভাবে গুলি করে। এ লাইনে নেএকোনার জীবন সরকার ( অন্য দু’ জনের নাম মনে নাই) ছিল। বাকি চারজনের মধ্যে উপেন্দ্র চন্দ্র রায় ছাদ হতে লাফ দিয়ে ডাইনিং হলের দিকে পড়লে সংগে সংগে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মৃত অবস্থায় সে মাটিতে পড়ে। বাকী ছিলাম আমরা তিনজন। আমি, মৃণাল বোস ( মুকুল বোসের বড় ভাই) এবং সত্যরঞ্জন দাস। আমাদের তিনজনকে হত্যা করার পূর্বে পাকসেনারা ‘ বাংলাদেশ খালি কর দেগা ’, ‘ বাংলাদেশ শহীদ মিনার পিয়ার করতা হায় ’ ইত্যাকার মন্তব্য করতে থাকে। আমাদেরকে লাইনে দাঁড় করানোর সময় সর্বপ্রথমে ছিলাম আমি, পরে সত্যরঞ্জন এবং শেষে মৃণাল বোস। গুলি করার পূর্ব মুহূর্তে মৃণাল বোস লাইন থেকে সরে দাঁড়ালে তাঁকে রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করে সামনে নেয় এবং আমার পেছনে থাকা সত্যরঞ্জনও আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। অর্থাৎ মৃণাল বোস প্রথম দ্বিতীয় সত্যরঞ্জন এবং সবশেষে আমি। সত্য ও মৃণাল উভয়েই আমার চেয়ে একটু লম্বা ছিল। এমন সময় একজন পাকসেনা আমাদেরকে গুলি করে। শুধু রক্তিম আভা বুঝলাম, এরপর কিছুই বলতে পারি না। অনুমান মিনিট দুই পর আমার জ্ঞান ফিরে আসে। চেয়ে দেখি হানাদার বাহিনীর লোকজন ছাদের উপর পানির ট্যাঙ্কের ভিতর কিছু আছে কিনা তা অনুসন্ধান করছে। আমার বুক তখন রক্তাক্ত এবং ডান হাত অবশ, চিৎ হয়ে পড়ে আছি ছাদে। সংগে সংগে মরার ভান করে পড়ে থাকি। সকাল ০৭- ৩০ হানাদার বাহিনী ছাদ হতে নিচে নেমে আসে এবং বলে ‘ সব শালা খতম হো গিয়া ’। এ সময় তারা একটা গুলি করে যা ছাদের উপর পড়লে ইট- সুরকি আমার পায়ের পাতায় ঢুকে যায়। পাকবাহিনী ছাদের উপর হতে নেমে গেলে সবাইকে মৃত অবস্থাায় দেখি। ছাদের উপর ০৯ জনের মধ্যে একমাত্র আমিই ছিলাম অর্ধমৃত। প্রাণে বাঁচার জন্য আমি হামাগুড়ি দিয়ে ছাদের দক্ষিণ দিকের সিড়ি দিয়ে নামার চেষ্টা চালাই। ঠিক এমন সময় দু’জন হানাদার আবার ছাদের উপর ওঠে। আমাকে আহত রক্তাক্ত এবং চলন্ত অবস্থা দেখে ‘ টের’ বলে আদেশ দেয়। আমি তখন নিশ্চিত মৃত্যু জেনে বাম হাতের উপর মাথা রেখে পিঠে আর একটি গুলির অপেক্ষা করছি। কিন্তু হানাদার বাহিনী ২৩ শে মার্চের প্রতিরোধ দিবসের কালো এবং বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা দু’টি পানির ট্যাংকের উপর হতে নামিয়ে মৃতদেহের রক্তের উপর ফেলে ছাদ হতে নেমে যায়। নামার সময় আমাকে পিঠের উপর দু’টো লাথি মারে।… ” এভাবেই অলৌকিকভাবে সেদিন তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন।
জগন্নাথ হলের মাঠে ড. জি. দেব, ড. মনিরুজ্জামান, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, মধুদা ও অন্যান্য ছাত্রদেরকে হানাদার বাহিনী গণকবর দেয়। হাউজ টিউটর অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যকেও হত্যা করা হয়। আহত অবস্থায় সুরেশ দাস ঢাকার যে হাসপাতালে সাময়িকভাবে চিকিৎসা নিয়েছিলেন সেখানে ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরও আহত অবস্থায় ছিলেন এবং তিনি সেখানেই মারা যান। শুধুমাত্র বেঁচে গিয়েছিলেন সুরেশ দাস। এদিকে এলাকায় আত্মীয়- স্বজনসহ সকলেই জানতেন তিনি মারা গেছেন। অবশেষে তিনি অনেক কষ্ট করে আহত অবস্থাায় নিজ জন্মস্থান সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লায় পৌছেন। পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীর বর্বরতার কথা তিনি এলাকার মানুষের
কাছে তোলে ধরেন, যুবকদেরকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংগঠিত করেন এবং নিজেও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তিনি ।
লাওভা ইয়ূথ ক্যাম্প যেখানে বালাট মুক্তিবাহিনী ক্যাম্প হতে প্রেরিত যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক ট্রেনিং দেয়া হতো সেখানে ডেপুটি ক্যাম্প ইনচার্জ এবং পরে ক্যাম্প ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালেন করেছেন। ভারতের ক্যাপ্টেন সমরেশ দাশ ছিলেন লাভা বা লাওভা ক্যাম্পের দায়িত্বে।
স্বাাধীনতাউত্তর সময়ে তিনি দেশ গঠনের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। সারাজীবন তিনি পরিচ্ছন্ন রাজনীতি করে গেছেন। প্রগতিশীল রাজনৈতিক আদর্শে বিশ^াসী ছিলেন। পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন একজন দক্ষ আইনজীবী। জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন । তিনি সাধাসিধে জীবন যাপন করতেন। মানুষের সুখে- দুঃখে পাশে থাকার, খোঁজখবর নেয়ার একটি সহজাত গুণ ছিল তাঁর। তাঁর একমাত্র জামাতা সুব্রত তালুকদার স্মৃতিচারণা করে বলেন, “ বিয়ের পর থেকে বাবাকে আমি দুর্গাপূজোতে বিশেষ করে পাঞ্জাবি কিনে দিতাম। দামী পাঞ্জাবি কিনে দেয়ার শখ থাকলেও সেটা সম্ভব ছিল না। কারণ তিনি ওসব পছন্দ করতেন না। সাদাসিধে কাপড় চোপড়ই ছিল তাঁর পছন্দ। তাই অনেক সময় একটু দামী পাঞ্জাবি কিনে দিলেও উনার কাছে দামটা কমিয়ে বলতাম। তিনি সুনামগঞ্জ হতে সিলেটে আমাদের বাসায় বেড়াতে আসলে দেখতাম তিনি সিলেটে অবস্থানরত এলাকার মানুষের খোঁজ খবর নিচ্ছেন। রোগী দেখতে এ হাসপাতাল থেকে ওই হাসপাতালে ছুটে যাচ্ছেন। অধিকাংশ সময় তিনি পায়ে হেটেই চলাফেরা করতেন।” “ সিম্পল লিভিং, হাই থিঙ্কিং” এমনটাই ছিল তাঁর জীবন চলার ধরণ।
ছোটবেলা থেকেই আমি বীর মুক্তিযোদ্ধা এ্যাডভোকেট সুরেশ দাসের নাম শুনে আসছি। অনেক সময় দূর থেকে দেখেছি, বক্তব্য শুনেছি। ঠিক আলাপ পরিচয় ছিল না। মৃত্যুর বছর খানেক আগে তাঁর সুনামগঞ্জের বাসায় প্রথম সরাসরি কাছে বসে তাঁর কথা শোনার, কথা বলার সৌভাগ্য হয়। সেদিন মুক্তিযুদ্ধ, ২৫ মার্চের ভয়াবহ সেই কালো রাত, সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার পেরুয়া গণহত্যা নিয়ে কথা হয়েছিল। সেদিন তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় হতে প্রকাশিত সেই কালো রাত নিয়ে স্মৃতিচারণামূলক একটি একটি গ্রন্থ’ আমাকে দেখতে দিয়েছিলেন, যেখানে তাঁর লিখা একটি প্রবন্ধও ছিল। সেই গ্রন্থে ছাপা হওয়া তার তারুণ্যদীপ্ত ছবিটির দিকে আমি অপলক তাকিয়ে ছিলাম। হালকা কাল গোফ, মাথায় কাল ছোট বাবরি চুল, উজ্জ্বল চোখ, দৃঢ়, প্রত্যয়ী, ঋজু, মেধাবী মুখ।
সর্বশেষ ১৫ অক্টোবর ২০১৬ তারিখ তাঁর সাথে দেখা হয় শাল্লার শাহিদ আলী পাবলিক পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক ধীরেন্দ্র চন্দ্র দাস রায় ( সম্পর্কে সুরেশ দাসের আপন ভাগনা ) স্যারের মেয়ে ডা. সুস্মিতা দাস রায় এর বিয়েতে সিলেটের একটি কমিউনিটি সেন্টারে। নমস্কার দিয়ে সৌজন্য মূলক দু’একটি কথা বলেছি এপর্যন্তই। মনে পরে সেদিন পাজামা পাঞ্জাবী পড়ে তিনি ধীরে ধীরে পায়চারি করছিলেন, এঁর ওঁর সাথে কথা বলছিলেন। কে জানত এ দেখাই শেষ দেখা হবে! মাত্র ক’দিন পরই তিনি আমাদেরকে ছেড়ে এভাবে চলে যাবেন!
জাতীয় পর্যায়ে তাঁর পরিচিতি ছিল। আজ যারা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের অনেকেই তাঁর বন্ধু বান্ধব। তিনি ছিলেন নিরহংকারী, নির্লোভ। তিনি ইচ্ছে করলে রাজধানী ঢাকাতেই স্থায়ীভাবে থেকে যেতে পারতেন। কিন্তু না, কর্মক্ষেত্র হিসেবে তিনি নিজ জেলা সুনামগঞ্জকেই বেছে নেন। হয়ত নিজ জন্মস্থান অবহেলিত শাল্লা তথা সুনামগঞ্জের জন্য হৃদয়ের গভীরে অন্যরকম কোন টান ছিল তাঁর।
অ্যাডভোকেট সুরেশ দাস ১৯৪৫ সালে সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা উপজেলার নয়াগাও ( রহমতপুর) গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। পিতা ঠাকুর চাঁন দাস, মাতা জানকি বালা দাস। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, এক ছেলে, এক মেয়ে, আত্মীয় স্বজন সহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। অত্যন্ত সজ্জন মেধাবী এই মানুষটি আমৃত্যু ছিলেন কর্মমুখর। ’৭১ এ তিনি মৃত্যুকে একবার জয় করেছিলেন। আজ তিনি স্বশরীরে আমাদের মাঝে নেই। ছোটবেলা পড়েছিলাম,“ মানুষ বেঁচে থাকে কর্মে, বয়সের মাঝে নয়।”বীর মুক্তিযোদ্ধা এ্যাডভোকেট সুরেশ দাসও বেঁচে থাকবেন চিরদিন আমাদের মাঝে তাঁর কর্মের মাঝে। তিনি সত্যিই মৃত্যুঞ্জয়ী।
সুব্রত দাশ
কোষাধ্যক্ষ, বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ, সিলেট জেলা শাখা।