২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর কোটি কোটি ভক্তকে কাঁদিয়ে এ নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নেন হাওরপাড়ের মানুষের সবচেয়ে প্রিয়জন বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম। শাহ আব্দুল করিম না থাকলেও তার রেখে যাওয়া গান আজো মুখরিত করে মানুষকে। শাহ আব্দুল করিম শুধু বাউল নন। তিনি একজন রাজনীতিক ও দেশের যে কোন সংকটময় মুহূর্তে তিনি প্রহরীর মতো দেশমাতার কাছে দাঁড়িয়েছেন।
হাওর-বাঁওর, খাল-বিল ও নদী-নালার দেশ সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার তাড়ল ইউনিয়নের ধলআশ্রম গ্রামে ১৯১৬ ইংরেজির ১৫ ফেব্রুয়ারি কালজয়ী পুরুষ শাহ আব্দুল করিম জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ইব্রাহীম আলী এবং মায়ের নাম নাইওরজান বিবি। ভাটির নিজস্ব পরিবেশ ও প্রকৃতি এখানকার মানুষদের করে তোলে ভাবুক, আউল-বাউল, শাহ আব্দুল করিমও তাদের মধ্যে একজন। কৃষি মজুর অভাবী পরিবারে তাঁর জন্ম। অভাবের সাথে যুদ্ধ করে শুরু হল জীবন।
শাহ আব্দুল করিমের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রয়াত জননেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ২০০৯ সালে করিম লোক উৎসবে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেন, সংসারের অভাব, কালনীর জল আর বরাম হাওরের ঢেউ রাখাল বালক শাহ আব্দুল করিমকে বাউল সম্রাটে পরিণত করেছে।
শাহ আব্দুল করিমের একমাত্র পুত্র শাহ নুর জালাল পিতার স্মৃতিচারণ করেন এভাবে, এই মিনতি করিরে বন্ধু ছাইড়া যাইওনা, আমিতো জানিরে বন্ধু তুমি আপনা।
না একমাত্র পুত্রের সে আহ্বানে তিনি সাড়া দেননি। সবাইকে শোকসাগরে ভাসিয়ে তিনি পারি জমান পরপারে। বাউল স¤্রাটের ভক্ত বাউল নূর জাহান তার মনের আকুতি প্রকাশ করে বলেন, আসি বলে গেলো বন্ধু আইলোনা/আসবে বলে আশায় রইলাম, আশাতে নইরাশা হইলাম/ বাটাতে পান সাজাই থইলাম, আইয়া বন্ধে খাইলোনা।
নূর জাহানরা মনে করেন তাদের গুরু গানের মাধ্যমেই তাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন আজীবন। শুধু নূর জাহান নয়, হাজারো করিম ভক্ত ভিড় জমান শাহ আব্দুল করিমের উজানদল গ্রামে।
দেশমাতৃকার প্রতি শাহ আব্দুল করিমর ছিল অগাধ ভালোবাসা। দেশের যেকোনো সংকটময় মুহূর্তে নিজে আবির্ভূত হয়েছেন স্বমহিমায়। নিজের সৃষ্টিকর্ম দিয়ে দেশকে সবসময় কিছু দেয়ার চিন্তা করেছেন এ গুণী। কোন কিছুর বিনিময় তিনি কখনো আশা করেননি। শাহ আব্দুল করিমের জীবনকর্ম পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ৫৪’র নির্বাচন, ৬৯এর গণআন্দোলন, ৭১’এর মুক্তিযুদ্ধ, ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানসহ প্রতিটি পর্যায়ে স্বরচিত গণসঙ্গীত পরিবেশন করে জনতাকে দেশ মাতৃকার টানে উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করেছেন। তাঁর গণসঙ্গীতে মুগ্ধ হয়ে মাওলানা আব্দুল হামিদ থান ভাসানী তাঁর পিঠে হাত রেখে বলেছিলেন- বেটা, গানের একাগ্রতা ছাড়িও না, তুমি একদিন গণমানুষের শিল্পী হবে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গণসঙ্গীত শুনে ১৮৫ টাকা দেন। শেখ মুজিব ১১ টাকা দিয়ে বলেন- তোমার মতো শিল্পীকে উপযুক্ত মর্যাদা দেয়া হবে।
দেশের জন্য শাহ আব্দুল করিম যেমনি ছিলেন উদার দেশও তার প্রতিদান দিতে চেষ্টা করেছে। অসংখ্য পদক ও সম্মাননা পেয়েছেন বাউল সম্রাট। ২০০১ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার শাহ আব্দুল করিমকে ‘একুশে পদক’ প্রদান করে। এছাড়াও মেরিল প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা, রাগীব-রাবেয়া সাহিত্য পদক, সিলেট সিটি কর্পোরেশন নাগরিক সংবর্ধনা, নিউয়র্ক হাসন রাজা লোক উৎসব সম্মাননাসহ অসংখ্য পদক ও সম্মাননার তালিকা রয়েছে এ গুণী শিল্পীর।
‘মন মজালে ওরে বাউলা গান/ তুমি আমায় যা দিয়েছো কি দেব তার প্রতিদান। …তত্ত্ব গান গেয়ে গেলেন যারা মরমী কবি আমি তুলে ধরি দেশের দুঃখ-দুর্দশার ছবি। বিপন্ন মানুষের দাবি করিম চায় শান্তি বিধান।’
বাউল গানের জন্য দেশে এখন পর্যন্ত কোন উন্নত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি। শাহ আব্দুল করিম বাউল একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা এখন দিরাইবাসী তথা সারাদেশের বাউল ভক্তদের প্রাণের দাবি। ২০০৯ সালের করিম লোক উৎসবে দিরাই-শাল্লার তৎকালীন সংসদ সদস্য ঘোষণা দিয়েছিলেন- আগামী লোক উৎসবের আগেই বাউল করিম একাডেমির কাজ শুরু হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এর কোন বাস্তবায়ন লক্ষ করা যায়নি। শাহ আব্দুল করিমের শেষ ইচ্ছা ছিল করিম একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা। তিনি মরে গেলে যেন দেশের করিম ভক্তরা তথা বাউলমনা মানুষগুলো বাউলগানের চর্চা করতে পারে এই প্রতিষ্ঠান থেকে। সে লক্ষ্যে নিজের বাড়ির আঙিনায় কাজ শুরুও করেছিলেন। কিন্তু তার বাস্তবায়ন হয়নি। বিভিন্ন সময় সরকারের কর্তারা বাউল আব্দুল করিম একাডেমি প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। তাই করিম ভক্তরা দেশের বিত্তবান, স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের আহ্বান জানিয়েছেন শাহ আব্দুল করিমের শেষ ইচ্ছা পূরণে সহযোগিতার হাত বাড়ানোর জন্য।
শাহ আব্দুল করিম ছিলেন একজন নিঃস্বার্থ বাউল। তিনি নিজের জন্য কিছুই করেননি। এমনকি ভাবেনওনি। তাই তিনি তাঁর সৃষ্টিকর্ম প্রায় দেড়হাজার গান মানুষের জন্য রেখে গেছেন। নিজ উদ্যোগে সেই গানের বই প্রকাশ করেছেন। বর্তমানে বাজারে রয়েছে তাঁর কয়েকটি বই। তাঁর প্রথম বই আফতাব সঙ্গীত তাঁর সহধর্মীণির নামে বইটির নাম। এরপর প্রকাশিত হয়েছে গণসঙ্গীত, ধল মেলা, ভাটির চিঠি, কালনীর কূলে, সর্বশেষ ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয়েছে শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্র। এছাড়াও বাংলা একাডেমী তাঁর ১০টি গান ইংরেজিতে অনুবাদ করে প্রকাশ করেছে।
শাহ আব্দুল করিম একজন আধুনিক বাউল। তার গানের কথা ও সুরে এর পরিচয় পাওয়া যায়। শাহ আব্দুল করিমের গান সকল মানুষের কাছে সমান জনপ্রিয়। বাউল সমাজের কাছে তার গান যেমনি জনপ্রিয় নতুন প্রজন্মের কাছে তা আরো বেশি জনপ্রিয়। শাহ আব্দুল করিম তাঁর গানের মাঝেই বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। কিন্তু শাহ আব্দুল করিমের শেষ স্বপ্ন পূরণে আমরা কি কিছুই করতে পারিনা? আসুন আমরা সবাই মিলে উদ্যোগ গ্রহণ করি ‘শাহ আব্দুল করিম বাউল একাডেমি’ প্রতিষ্ঠার জন্য।
দিরাই উপজেলার তাড়ল ইউনিয়নের ধলআশ্রম গ্রামে ১৯১৬ ইংরেজির ১৫ ফেব্রুয়ারি এই কালজয়ী পুরুষ শাহ আব্দুল করিম জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর কোটি কোটি ভক্তকে কাঁদিয়ে এ নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নেন তিনি। তার মৃত্যুদিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।
[লেখক : সাংবাদিক ও উন্নয়নকর্মী]